ঢাকা বুধবার, ৮ই মে ২০২৪, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১

শত কোটি টাকা মেরে বিদেশে বহাল তবিয়তে সিএএবির কর্মকর্তারা


৩১ জানুয়ারী ২০২৪ ১০:১৫

প্রতিকি

যুক্তরাজ্যে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য ছুটি নিয়েছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ( বেবিচক) লাইব্রেরিয়ান তানিয়া আক্তার। এরপর আর ফেরেননি। ছুটি চাওয়ার আগে কখনো নিজের অসুস্থতার কথা বলেছেন, কখনো বলেছেন প্রয়োজন ‘কমপ্লিট বেড রেস্ট’। ছুটি বাড়াতে প্রেগন্যান্সি লিভ নিয়েছেন। এরপর সেই ছুটি শেষেও ফেরেননি। সর্বশেষ অজুহাত দিয়েছেন ‘মেয়ের পাসপোর্ট হয়নি’। দীর্ঘ ১৯ মাস চিঠি চালাচালির পর তাকে বরখাস্ত করা হয়।

স্পর্শকতার বিষয় নিয়ে ছুটির আবেদনের পর তানিয়া যখন ফেরেনি তখন শুরু হয় তদন্ত। এক পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্নসাৎসহ নানা অভিযোগও উঠে। কিন্তু তাতে কি তানিয়া আর তো ফেরেনি। বহাল তবিয়তেই আলিসান জীবন যাপন করছেন যুক্তরাজ্যে।

শুধু তানিয়াই নন শত শত কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের আরো কয়েকজন কর্মকর্তা। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় তারা স্থায়ী হয়েছেন। দেশের টাকা মেরে সেখানে করছেন আলিসান জীবন যাপন।

যার যার বিরুদ্ধে অভিযোগ- মো. ইখতিয়ার ইসলাম ছিলেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ প্রকৌশলী। তিনি ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের শর্ত সাপেক্ষে লিয়েনে কানাডা গেছেন। ২০২২ সালের ১৩ মার্চ লিয়েনের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু তিনি দেশে ফেরেননি। স্বপদে কাজে যোগদান না করে কানাডার টরেন্টোয় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের মাধ্যমে নতুন করে দুই বছর লিয়েন বৃদ্ধির আবেদন করেন। তবে কর্তৃপক্ষ সেটি অ-বিবেচিত বলে মত দেয়।

গত ২০২২ সালের ১৪ মার্চ থেকে বিদেশে অবস্থান করতে থাকেন ইখতিয়ার ইসলাম। এতে কর্তৃপক্ষের কাজে বিঘ্ন ঘটে। লিয়েন পুনর্বিবেচনা বিষয়ে আবেদন অগ্রহণযোগ্য হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। পরে মামলার তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর বিধি ৪৯(গ) অনুযায়ী ‘পলায়নের’ দায়ে জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ প্রকৌশলী মো. ইখতিয়ার ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বেবিচকের অর্থ লোপাটের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধেও।
বেবিচক সদর দপ্তরে প্রকৌশল বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মো. শহীদুজ্জামান। দায়িত্বপালন সময়ে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন তিনি। কিন্তু ছুটি শেষ হলেও তিনি আর দেশে আসেননি। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বেবিচক। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ ও পলায়নের অভিযোগ এনে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়। শহীদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বেবিচকের বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত ১০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করে বেবিচক ২০২৩ সালের জুলাইয়ে। আবদুল খালেক তার স্ত্রীর বড় ভাইকে দেখতে দুই মাসের ছুটি নিয়ে ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর কানাডায় যান। কিন্তু ছুটি শেষে তিনি দেশে ফেরেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেবিচকের এই প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে সরকারি ৭ হাজার ৮৩০টি পে-অর্ডার উদ্ধার হয়, যেগুলো তিনি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে রেখেছিলেন। ২০ ক্যাটাগরিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল পে-অর্ডারগুলো। কিন্তু আবদুল খালেক বেবিচকের হিসাব শাখায় জমা না দিয়ে সেগুলো নিজের ড্রয়ারে রেখে দেন। অন্তত, ১০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও।

যশোর বিমানবন্দরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলমকেও খুঁজে পাচ্ছে না বেবিচক। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাঁচ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি (ক্যাজুয়াল লিভ) নিয়ে নিজ বাড়ি পাবনায় যান মাহবুব। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও আর কর্মস্থলে ফেরেননি। এ বিষয়ে ২২ নভেম্বর তাকে নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য তলব করে বেবিচক। তার বাসায় চিঠি পাঠানো হয়; ম্যাসেজ দেওয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপেও। সেসময় তাকে সাতদিনের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হলেও তিনি আসেননি। তার অবস্থানও শনাক্ত করতে পারেনি বেবিচক। দুর্নীতির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধেও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেবিচকের অনেকেই দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে বিদেশে সটকে পড়ছেন। বিদেশে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে স্থায়ী চাকরিচ্যুতির শাস্তি ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংস্থাটি। এতে সংস্থাটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, কেউ দুর্নীতি করে দেশের বাইরে চলে গেলে সে আর ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে না। একটা অভিযোগ সামনে আসার পর দাপ্তরিক জটিলতার সুযোগে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তারা পায়। যে-ই দুর্নীতির সাথে জড়িত, তার বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদুল আলম বলেন, দুর্নীতি করে বিদেশ পালিয়ে যাওয়াদের ব্যাপারে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমানের গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছিলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে বেবিচকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।