ঢাকা সোমবার, ৫ই মে ২০২৫, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩২

সবুজবাগের আতঙ্ক গ্যাং থার্টি


১ মার্চ ২০২১ ০৭:৩৮

প্রতিকি

রাজধানীর সবুজবাগের মাদারটেকে ভয়ংকর আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। সুমন এবং অনিক ওরফে তোতলা অনিকের নেতৃত্বে এই গ্যাংয়ে রয়েছে ৩০ জন সদস্য। যাদের গ্যাং থার্টি নামে পরিচিত। কেউ বাড়ি নির্মাণ করতে গেলেই এই বাহিনীর সদস্যদের চাঁদা দিতে হয়। মাদক সেবন, ব্যবসা, ছিনতাই এবং ইভটিজিংসহ নানা অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে।

সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে খুনোখুনি ও ফিল্মি কায়দায় দিনদুপুরে ডাকাতির ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের পরিচয়ে চলার কারণে তাদের ভয়ে অনেকেই মুখ খোলার সাহস পান না। এলাকাবাসী সব সময় থাকেন থার্টি গ্যাং সদস্যদের আতঙ্কে। নির্মাণাধীন একটি বাড়িতে চাঁদার দাবিতে ধারাবাহিক হুমকি, হামলা এবং লুটপাটের অভিযোগে শনিবার রাতে সবুজবাগ থানায় মামলা করা হয়েছে। মামলায় সুমন এবং অনিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ৩০-৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, মাদারটেকের বাগানবাড়ি ১৪১/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে প্রায় ছয় কাঠা সম্পত্তির মালিক ছয় ভাই-বোন। সেখানে তারা বছর দেড়েক আগে ছয়তলা ফাউন্ডেশনে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ইতোমধ্যে ওই বাড়ির অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ। এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। শুরু থেকেই স্থানীয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা চাঁদা দাবি করে আসছিল।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টায় তোতলা অনিক ও সুমন নেতৃত্বে কিশোর গ্যাং সদস্যরা ভবনের গেটে আসে। এসেই তারা জসিম (ভবন তত্ত্বাবধায়ক) কোথায় তা জানতে চায়। জসিমের সঙ্গে দেখা করতে তারা জোর করে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। নিরাপত্তাকর্মী তাদের বাধা দেয়।

এ সময় তোতলা অনিক ও সুমন অকথ্য ভাষায় নিরাপত্তাকর্মীকে গালিগালাজ করে এবং জসিমকে হুমকি দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। পরদিন শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে তোতলা অনিক ও সুমনের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এসে ভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে নিরাপত্তাকর্মী বাধা দেয়।

এ সময় তারা ভবনের সীমানা প্রাচীর ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। আধা ঘণ্টা পর তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। রড ও বাঁশ দিয়ে তারা ভবনের বেসিন, বেসিন টাইলস ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ভাঙচুর করে। এ সময় ৩০ হাজার টাকার বেসিন, ২৫ হাজার টাকার টাইলস নষ্ট করা হয়। যাওয়ার সময় তারা ১৪ কার্টুন টাইলস, ৪০০ কেজি রড ও নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ৩০-৪০টি বাঁশ নিয়ে যায়। এ সময় নিরাপত্তাকর্মী ফারুক হোসেনকে একটি রুমে আটকে রাখা হয়।

ভবনের তত্ত্বাবধায়ক জসিম উদ্দিন বলেন, আগের রাতে হত্যার হুমকি দেওয়ার কারণে আমি পরদিন ভোরেই আত্মগোপনে চলে যাই। যদি আত্মগোপনে না যেতাম তাহলে এদিন (শুক্রবার) তারা আমাকে হত্যা করত।

তিনি বলেন, বিষয়টি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানালে কিশোর গ্যাং সদস্যরা আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ে। পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে শনিবার রাত পৌনে ১২টায় ভবনে হামলা চালায় তোতলা অনিক ও সুমনের নেতৃত্বে কিশোর গ্যাংয়ের ২৫-৩০ জন সদস্য। ভবনের সামনে এসে তারা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘জসিম কোথায়? বেরিয়ে আয়। আজ তোকে দেখে নেব।’

তাদের ভয়ে আমি নির্মাণাধীন ভবনের নিচতলায় একটি রুমে ভেতর গিয়ে লাইট বন্ধ করে দিই। আমাকে বাঁচানোর জন্য নিরাপত্তাকর্মী রুমের বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়। হামলাকারীরা বুঝতে পারেনি যে, আমি রুমের ভেতর আছি। তাদের জিজ্ঞাসায় নিরাপত্তাকর্মী জানিয়েছিল, ‘জসিম এখানে নেই। বৃহস্পতিবার আপনারা আসার পর শুক্রবার সকালেই তিনি এই এলাকা ছেড়ে গেছেন।’ জসিম বলেন, কিশোর গ্যাং বাহিনীর হামলার খবর পেয়ে সবুজবাগ থানার এসআই মঞ্জুরের নেতৃত্বে একটি টিম ঘটনাস্থলে আসে। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

তিনি বলেন, এ গ্যাংয়ের নেপথ্য লিডারের নাম খায়রুল ইসলাম মিঠু। আমরা তাকে মামলায় আসামি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটি ছাত্র সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় এই মুহূর্তে এজাহারে তার নাম দিতে পুলিশ নিষেধ করেছে।

পুলিশ জানিয়েছে, তদন্তে যদি তার নাম আসে তবে চার্জশিটে (অভিযোগপত্র) তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

স্থানীয় যুবক ইকরাম হোসেন বলেন, কয়েকদিন আগে মাদারটেক চৌরাস্তা এলাকায় বসে আমি সিগারেট খাচ্ছিলাম। এ সময় কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য এসে আমাকে বলে, ‘তোকে বড় ভাই ডাকছে।’ পরে তারা আমাকে ওই বড় ভাইয়ের কাছে নিয়ে যায়। ধূমপানের অপরাধে কথিত বড় ভাইয়ের নির্দেশে কিশোর গ্যাং সদস্যরা মারধর করে আমার কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।

সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, আমি এবং আমার দল কিশোর গ্যাং সদস্যদের প্রশ্রয় দেয় না। গত সেপ্টেম্বরে এই এলাকায় সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর নিহত হয়। আমাদের অবস্থান কিশোর গ্যাংবিরোধী হওয়ায় দ্রুত আসামি গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি কিশোর গ্যাং সদস্যরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে এ বিষয়ে কঠোর হতে অনুরোধ জানিয়েছি।

স্থানীয় ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্যদের সাম্প্রতিক তৎপরতায় আমি বেশ উদ্বিগ্ন। মাদারটেক চৌরাস্তায় নির্মাণাধীন বাড়িতে অব্যাহত হামলা, লুট, হুমকি এবং ভাঙচুরের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছি। যে দলেরই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশকে অনুরোধ জানিয়েছি।

এ বিষয়ে সবুজবাগ থানার ওসি মোরাদুল ইসলাম বলেন, মাদারটেকের কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপতৎপরতার বিষয়টি আমি অবগত। শনিবার রাতে ঘটনাস্থলে ফোর্স পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের পাওয়া যায়নি। পুলিশের তৎপরতার কারণে তারা এখন গা ঢাকা দিয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছি। আশা করছি শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনতে পারব।

পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুল হক চৌধুরী বলেন, গত কয়েকদিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে মাদারটেক এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেখানে একজন এসআইয়ের নেতৃত্বে সার্বক্ষণিক টহল টিম কাজ করছে। তিনি বলেন, টাকার জন্য মিঠুর নেতৃত্বাধীন কিশোর গ্যাং সদস্যরা নানা অপকর্ম করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এই গ্যাংয়ের সব সদস্যকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।