‘ফ্লাইট এক্সপার্টের’ প্রতারণা: টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুক্তভোগীরা

হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’। মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন ফ্লাইট এক্সপার্টের প্রতিষ্ঠাতা সালমান বিন রশিদ শাহ সায়েম। অল্প দিনেই নানা অফারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটির এমন ভয়াবহ প্রতারণায় হতবাক সবাই। প্রতিষ্ঠানটি থেকে অগ্রিম টিকিট কেনা এজেন্সি ও ব্যক্তি সবার এখন মাথায় হাত। তারা টাকা ফেরত পাবে কিনা, তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ফ্লাইট এক্সপার্টের এমন অপ্রত্যাশিত প্রতারণার কারণে চরম হুমকি, এমনকি অস্তিত্ব সংকটের মতো পরিস্থিতিতেও পড়তে যাচ্ছে বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সি।
অনলাইনে এ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ইউসুফ আহমেদ আহমেদ তুহিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, কিউকমের পর এবার অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’—আবারও গ্রাহকের অগ্রিম নেওয়া কয়েকশ কোটি টাকা নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের উধাও হয়ে যাওয়ার অভিযোগ। আসলে এরা দেশের অনলাইন সেবা খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাকে একেবারে তলানিতে নিয়ে গেছে। লোভনীয় অফার দিয়ে অগ্রিম টাকা সংগ্রহ, তারপর পরিষেবা বা পণ্য দিতে ব্যর্থ হওয়া—এই চক্র যেন দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য এক ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে উঠেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কিনা, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে যারা এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
ফ্লাইট এক্সপার্টের প্রতারণার শিকার ইউনিয়ন ট্রাভেলসের মালিক মুহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সবাই আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সমিতির (আইএটিএ) সদস্য। আমরা সরাসরি এয়ারলাইনস থেকে টিকিট কিনতে পারি। সাত-আট বছর ধরে ফ্লাইট এক্সপার্ট যেটা করতো—১০০ টাকার টিকিট তারা ৯৫ টাকায় বিক্রি করতো। কাস্টমাররা এটা নিয়ে অভিযোগ দিতো। আমরা দাম কেন বেশি নিচ্ছি। ফলে আমরা মার্কেটে তাদের সঙ্গে কম্পিটিশন করতে পারতাম না। তাই বাধ্য হয়ে ফ্লাইট এক্সপার্টের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা করতে হয়েছে। তারা মার্কেট ডমিনেট করতো সবসময়।’
মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘এখন মালিকপক্ষ পালিয়ে যাওয়ায় আমাদের অনেকের ২০-৩০ লাখ টাকা করে আটকে গেছে। হিসাব করে দেখলাম, আমার ৫০ লাখ টাকা আটকে আছে ফ্লাইট এক্সপার্টের কাছে। এখানে একজনকে পেয়েছি—যার এক কোটি টাকার ওপরে আটকে গেছে। আর এখানে যারা আজ উপস্থিত হয়েছেন—তারা সবাই ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে প্রচুর লোক আছে।’
ভিসা এইড ট্রাভেলসের মালিক আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ফ্লাইট এক্সপার্টের সঙ্গে বি টু বি কাজ করি। আগে জানতাম, ফ্লাইট এক্সপার্ট নিজে সব এয়ারলাইনসের কাছ থেকে টিকিট কেনে। কিন্তু গতকাল (শনিবার) সকালে জানলাম—ফ্লাইট এক্সপার্ট আসলে নিজে কোনও টিকিট কেনে না। বরং অন্যান্য এজেন্সির মাধ্যমে সে এই কাজগুলো করে।’
আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা একটা গ্যাপের মধ্যে পড়ে গেছি। অগ্রিম টাকা দিয়ে ফ্লাইট এক্সপার্ট থেকে টিকিট কিনি। কিন্তু এখন জানতে পারছি, ফ্লাইট এক্সপার্ট অন্য এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে বাকিতে টিকিট কিনতো। ফলে আমাদের টাকাগুলো আটকে আছে ফ্লাইট এক্সপার্টের কাছে। আর যেসব টিকিট এখনও ভ্যালিড আছে, সেগুলোর রিফান্ড করে নিচ্ছে ফ্লাইট এক্সপার্টের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এজেন্সিগুলো। আমরা যত টাকা লসে পড়েছি, সেটা তো পাচ্ছিই না, উল্টো যেটা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেটাও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।’
আপনারা এখন কী চাচ্ছেন জানতে চাইলে আজিজ বলেন, ‘আমরা চাই, এয়ারলাইনসগুলো যেন লাইভ টিকিটগুলো ক্যানসেল না করে। এই টিকিটের টাকাগুলো যেন রিফান্ড না করে। এটা করতে পারলেও আমরা অনেক ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারবে।’
কাজী খালেদ মাহমুদ নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমরা ১৭ জন মিলে একটা মামলা করেছি। অনেকে আমাদের মাধ্যমে হোটেল বুকিংসহ হজ-ওমরার জন্যেও টিকিট করে রেখেছেন। অনেক বিদেশিরাও টিকিট কিনেছেন। এখন তারা যদি এয়ারপোর্টে গিয়ে ফিরে আসে, তাহলে আমরা খুবই লজ্জায় পড়ে যাবো। এটা শুধু আমাদের লজ্জা না, পুরো দেশের জন্য লজ্জা। আন্তর্জাতিক মহলে এই ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের বদনাম হবে।’
এর আগে শনিবার (২ আগস্ট) দিবাগত রাতে বিপুল সরকার নামে এক গ্রাহক মতিঝিল থানায় ‘ফ্লাইট এক্সপার্টের’ বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন।
মতিঝিল থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ মহায়মেনুল ইসলাম বলেন, ‘মামলায় পাঁচ জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন— ফ্লাইট এক্সপার্টের এমডি সালমান বিন রাশিদ শাহ সায়েম ও তার বাবা এম এ রাশিদ, এজেন্সির হেড অব ফাইন্যান্স সাকিব হোসেন (৩২), চিফ কমার্শিয়াল অফিসার সাঈদ আহমেদ (৪০) ও চিফ অপারেটিং অফিসার এ কে এম সাদাত হোসেন (৩২)।’
ওসি আরও বলেন, ‘এর মধ্যে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন ফ্লাইট এক্সপার্টের হেড অব ফাইন্যান্স সাকিব হোসেন (৩২), চিফ কমার্শিয়াল অফিসার সাঈদ আহমেদ (৪০) ও চিফ অপারেটিং অফিসার এ কে এম সাদাত হোসেন (৩২)।’
মোহায়মেনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তদন্ত জারি রেখেছি। আসামিদের মধ্যে তিন জনকে গ্রেফতার করে কোর্টে পাঠানো হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টাকা ফেরতের বিষয়টি এখন বলা সম্ভব না। আমরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযানে রয়েছি।’
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের মার্চে যাত্রা শুরু করেছিল ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’। অনলাইনে কম দামে এয়ার টিকিট বুকিং, হোটেল রিজারভেশন, ট্যুর প্যাকেজ ও ভিসা প্রসেসিং—সব কিছু এক প্ল্যাটফর্মে এনে এটি খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পায়।