স্বাধীনতা যুদ্ধে যশোরে প্রথম রক্ত ঝরার দিন আজ

যশোরের মানুষের কাছে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঐতিহাসিক দিন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল এদিন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ যশোর শহরে মুক্তিকামী জনতার উত্তাল মিছিলে পাক বাহিনী গুলি চালালে শহীদ হন চারুবালা কর। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনিই প্রথম শহীদ। এরপর যশোরে সংগঠিত হতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের আন্দোলনকারীরা। এর নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদ।
পাক হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে এদিন শহরের টিএন্ডটি এলাকায় শহীদ হয়েছিলেন চারুবালা কর। ৩ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা। স্বতঃস্ফূর্ত জনতার বিশাল মিছিল বের হয় ঈদগাহ ময়দান থেকে। দড়াটানা মোড় ঘুরে কাপুড়িয়াপট্টি- চৌরাস্তা হয়ে মিছিলটি ঢোকে রেল রোডে।
সরকারি খাদ্য গুদামের সামনে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান দেখে তাদের দিকে ইট ও জুতা নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ওই সময় এক পাকসেনা বিক্ষুব্ধ জনতাকে ভয় দেখাতে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে, গুলিবিদ্ধ হয় আকাশে ভেসে বেড়ানো এক চিল। মৃত চিলটিকে নিয়ে মিছিলটি ঢোকে ভোলা ট্যাঙ্ক সড়কে। সার্কিট হাউসের ভেতরে পাক সেনাদের দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। তারা সার্কিট হাউস আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। বিভিন্ন মহল্লা থেকে বিক্ষুব্ধ মানুষ তখনও জড়ো হচ্ছিল সেখানে।
দুপুর ১২টার দিকে হানাদার বাহিনীর গাড়ি ঈদ গাহের পাশের রাস্তা অতিক্রম করার সময় জনতা আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জনতার দিকে অস্ত্র তাক করে হানাদাররা। নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে শান্ত হয় জনতা। ওই সময় খবর আসে টেলিফোন ভবন দখল করে নিয়েছে হানাদার বাহিনী। চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত ছাত্র-জনতার মধ্যে, উত্তেজিত ছাত্র-জনতার একটি অংশ ঈদগাহ ময়দান থেকে বেরিয়ে টেলিফোন ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় কোনো পূর্ব সতর্কীকরণ ছাড়াই টেলিফোন ভবনের ছাদ থেকে জনতার দিকে মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে হানাদার বাহিনী। টেলিফোন ভবনের পশ্চিম পাশে বর্তমান হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল এলাকায় বসবাস করতেন নিঃসন্তান পূর্ণ চন্দ্র কর ও তার স্ত্রী চারুবালা কর। হানাদার বাহিনীর ছোঁড়া বুলেট ঘরের গোলপাতার ছাউনি ভেদ করে বিদ্ধ হয় চারুবালা করের মাথায়। শহীদ হন তিনি।
হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে আহত হন অনেকেই। চারুবালা করের মরদেহ নিয়ে রাখা হয় যশোর সদর হাসপাতাল মর্গে। মর্গে তালা লাগিয়ে পাক সেনারা অবস্থান নেয় সেখানে। বাইরে হাজার হাজার মানুষ চারুবালা করের মরদেহ নেয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু পাক সেনারা মরদেহ দিতে নারাজ। অপেক্ষমাণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করে। ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে মানুষ। মুহূর্তে জনতা মর্গের তালা ভেঙ্গে বাইরে নিয়ে আসে চারুবালা করের মরদেহ, সূর্য তখন অস্তগামী, সৎকারের জন্য শহীদ চারুবালা করের মরদেহ নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটছে নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে, শবযাত্রায় পুরুষের সঙ্গে যোগ দেন বহু নারী। সবার চোখে মুখে প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি। তার লাশ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যশোরের সর্বস্তরের মানুষ মিছিল করে যশোর কালেক্টরেট ঘেরাও করে। এসময় তৎকালীণ ছাত্রলীগ নেতা ও পরবর্তীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই গুলির ভয় না করে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে কালেক্টরেট ভবনের পাইপ বেয়ে উঠে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেন। এসময় তিনি সে দন্ডে প্রতীকী পতাকা উড়িয়ে দেন, যা আজ ইতিহাস। সে সময়ের অসহযোগ আন্দোলনে আলোড়ন সৃষ্টি করে ৩ মার্চের এ ঐতিহাসিক ঘটনা।
নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে সমাধিস্থ করা হয় শহীদ চারুবালা করের মরদেহ। নীলগঞ্জ মহাশ্মশানের পাশে নদীর ধারে প্রগতী বালিকা বিদ্যালয়ের পেছনে মাটির সাথে মিশে আছে চারুবালা করের সমাধি; যার উপর দিয়ে বাড়ি তুলেছেন নীলগঞ্জ এলাকার এক বাসিন্দা। এক পাশে শুধু এক লাইন ইটের সারি ছাড়া আর কিছুই নেই সেখানে। নেই শেষ চিহ্নটুকুও।