ঢাকা রবিবার, ৬ই জুলাই ২০২৫, ২৩শে আষাঢ় ১৪৩২


যুদ্ধ বন্ধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধারের বিশ্বনেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহবান


২৫ অক্টোবর ২০২৩ ২৩:৩৮

ছবি সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের প্রতি শান্তি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য যুদ্ধ বন্ধ এবং দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মানবসংযোগ শান্তি ও অগ্রগতির লাইফলাইন। আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ, সংঘাত ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান ঘটাতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে জিজিএফ কনফারেন্স হলে আজ বুধবার ‘গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম’ সম্মেলনের উদ্বোধনী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণদানকালে একথা বলেন। তিনি বাংলাদেশের মসৃণ এলডিসি উত্তরণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অব্যাহত বাণিজ্য অগ্রাধিকারও চেয়েছেন।

এদিকে, বাংলাদেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নেওয়ার জন্য উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশকে প্রায় ১০০ কোটি ইউরো (প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা) সহযোগিতা দেবে ইইউ। নতুন সহযোগিতার বড় ক্ষেত্র হবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং কানেক্টিভিটি, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো সমাধানের জন্য ইইউ থেকে প্রযুক্তি সহায়তা চায় বাংলাদেশ। এছাড়া দুদেশের সম্পর্ককে কৌশলগত স্তরে নিতেও উভয়পক্ষ কাজ করবে।

আজ ব্রাসেলসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলার ভন ডার ইয়েনের মধ্যে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে দুই নেতা যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এমন অংশীদারিত্বের কথা চিন্তা করছি, যেখানে কৌশলগত উপাদান থাকবে। উরসুলার বলেন, আমাদের সম্পর্কের নতুন চ্যাপ্টার খুব ভালোভাবে শুরু হয়েছে।

গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের বক্তব্যে ইইউকে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশ্বস্ত বাণিজ্য, উন্নয়ন ও মানবিক অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের মসৃণ এলডিসি উত্তরণে ইইউ’র অব্যাহত বাণিজ্য অগ্রাধিকার চাই।’

প্রধানমন্ত্রী ইইউভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশে বিশেষ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং দেশজুড়ে হাইটেক পার্ক নির্মাণে বৃহত্তর বিনিয়োগের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগের অন্যতম আকর্ষণীয় পরিবেশ প্রদান করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সুতরাং, আমি ইইউ বিনিয়োগকারীদের আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কের সুবিধাগুলো অন্বেষণের আমন্ত্রণ জানাই।’ 

তিনি আরো বলেন, তার দেশের শালীন কাজ ও সার্কুলার অর্থনীতিতে আরো কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতের সঙ্কট মোকাবিলায় আরো ভালো প্রস্তুতি এবং পারস্পরিক সম্মান পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ সঙ্কটের জন্য আরো ভালোভাবে প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের অবশ্যই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম ২০২৩-এর সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য এটি এক মহান সংযোগ হিসেবে কাজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তিনি আরো বলেন, সবুজ হাইড্রোজেন উন্নয়নে বাংলাদেশ ইইউ’র সঙ্গে যোগ দিতে ইচ্ছুক।

তিনি বলেন, ‘আমরা সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দক্ষতা থেকে উপকৃত হতে পারি। আমাদের কৃষি উৎপাদন সংরক্ষণের জন্য আমাদের কোল্ড চেইন নেটওয়ার্কগুলোতে বিনিয়োগের প্রয়োজন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস ও চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প উৎপাদন বহুমুখীকরণে ইইউ’র প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে পারে। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের আগামীদিনের ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে অংশীদার খুঁজছি।’ 

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের গতিশীল তরুণ জনগোষ্ঠী ইইউ’র দক্ষতা ও প্রতিভা অংশীদারিত্ব কর্মসূচিতে যোগ দিতে প্রস্তুত।

তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি গ্লোবাল গেটওয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের গতিশীলতার ক্ষেত্রে তাদের ফলপ্রসূ সহযোগিতা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিন্ন মূল্যবোধ ও অঙ্গীকার ইইউ’র সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিতে আলোচনা শুরু করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের জন্য ৩৫০ মিলিয়ন-ইউরো ঋণের জন্য ইআইবি’র সঙ্গে একটি যুগান্তকারী চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।’

বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের এই ৫০তম বার্ষিকীতে তিনি বলেন, ‘আমি আমাদের কৌশলগত সম্পৃক্ততা আরো জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি কারণ আমাদের ৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ১৫ বছরেরও কম সময়ে ৪৬৫ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। আমরা আমাদের লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছি। চরম দারিদ্র্য ২০০৬ সালের ২৫.১ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের এলডিসি মর্যাদা থেকে উন্নীত হতে চলেছে।

তিনি বলেন, তার সরকার খাদ্য নিরাপত্তা, সর্বজনীন প্রথমিক শিক্ষায় ভর্তি, কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, বিনাখরচে আবাসন, গ্রামীণ যোগাযোগ, দুর্যোগ স্থিতিস্থাপকতা, জলবায়ু অভিযোজন, শতভাগ বিদ্যুৎ কভারেজ, দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ, শিল্প প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা জলবায়ু ঝুঁকি সহনশীলতা ও সমৃদ্ধির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, তার বাবা; বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক সেতুবন্ধ নির্মাতা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে কৌশলগতভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত এবং এটির এ অঞ্চলের তিন বিলিয়ন গ্রাহকের একটি বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও বন্দর অবকাঠামো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডরের অংশ হিসেবে নির্মিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করেছি। আমরা নেপাল, ভুটান ও উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থল-সংযুক্ত অঞ্চলগুলোকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের বিমানবন্দরগুলো পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে। আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশ ও ইইউ’র মধ্যে সংযোগ একটি সাধারণ বন্ধনমূলক উপাদান। আমরা পরিবহন নেটওয়ার্ক, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, সবুজ জ্বালানি, ডিজিটাল রূপান্তর, গবেষণা ও উদ্ভাবনের ওপর গ্লোবাল গেটওয়ের ফোকাসের প্রশংসা করি।

উরসুলার ভন ডার ইয়েনের সঙ্গে যেসব বিষয়ে আলোচনা: দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেওয়া, পার্টনারশিপ ও কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট চুক্তি সইয়ের জন্য আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত, জলবায়ু পরিবর্তন ও কানেক্টিভিটি-কেন্দ্রিক সহযোগিতা, নতুন তহবিল জোগানের উৎসসহ আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই নেতার মাঝে আলোচনা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বাংলাদেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছি। আমরা উভয়ই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিষয়ে আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি।

উরসুলার বলেন, গ্লোবাল গেটওয়ে প্রায় ১০০ কোটি ইউরো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে এবং আমরা এখানেই থেমে থাকবো না।

দুই বিনিয়োগ প্যাকেজ: দুটি বিনিয়োগ প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশকে ইইউ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ইউরো তহবিল জোগান দেবে। এর মধ্যে ৪০ কোটি ইউরোর বেশি দেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য। দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় দেবে সাত কোটি ইউরো এবং এটি ব্যয় হবে প্রশাসনিক উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও সবুজায়নের জন্য।

বাজার অগ্রাধিকার: ইইউ হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার এবং ওই জোটের জিএসপির আওতায় বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায়। এই সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত পাবে বাংলাদেশ। কারণ, দেশটি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে ২০২৬ সালে বের হয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করি ইইউ আমাদের জিএসপি প্লাস সুবিধা দেবে, যাতে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সহায়তা করে।