ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯শে জুলাই ২০২৫, ১৫ই শ্রাবণ ১৪৩২


চূড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির দুই বছর, সরেনি রাসায়নিকের গুদাম


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২৭

সংগৃহিত

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দ্বিতীয় বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৯ সালের এইদিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছিল ৭৮ জনের। কিন্তু দুই বছর পরও এখনো তেমনই আছে সেখানকার পরিবেশ। সরেনি রাসায়নিকের গুদাম, নেই ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার অগ্রগতি। বাস্তবায়ন হয়নি নিহতদের স্বজন ও আহতদের জন্য ঘোষিত ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতিও।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ১০ মিনিটে প্রথমে নন্দকুমার দত্ত সড়কের চুড়িহাট্টা মসজিদ গলির রাজ্জাক ভবনে আগুন লাগে। সেই আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের আরো কয়েকটি ভবনে। আর গোটা এলাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। এটি ছিল পুরান ঢাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দ্বিতীয় ঘটনা। এর ৯ বছর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিল ১২০ জন। পুরান ঢাকায় এমন বড় ধরনের দুটি আগুনের ঘটনার পরও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্টদের।

এদিকে চুড়িহাট্টার ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তার কিছুই পাননি তারা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেকেই চলে গেছেন গ্রামে। হতভাগ্য পরিবারগুলোর খোঁজখবরও নেয় না কেউ।

মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনার পর এই এলাকার সব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তৎকালীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। তখন সেখানে অবস্থিত কারখানা চিহ্নিত করে সেগুলো কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন আজো হয়নি। এখনো অনেক বাসাবাড়িতে রয়েছে রাসায়নিক গুদাম। চুড়িহাট্টায় যে রাজ্জাক ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, সেই ভবনের নিচতলায় ছিল রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা। দীর্ঘদিন ধরে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই চকবাজারের যত্রতত্র গড়ে উঠেছে উচ্চ মাত্রার দাহ্য পদার্থের মজুত, প্লাস্টিক ও পারফিউম কারখানা।

পরিবেশ আন্দোলনকারী আবু নাসের খান বলেন, পুরান ঢাকায় যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের কয়েক হাজার গুদাম, কারখানা বা দোকান থাকলেও বেশিরভাগেরই নিবন্ধন বা লাইসেন্সসহ কোনো কাগজপত্র নেই। এসব ব্যবসায়ী এবং তাদের সহায়তাকারী স্থানীয় লোকজনের ভোট ব্যাংক রয়েছে। তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই কর্তৃপক্ষ কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে না। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা পরিবেশ অধিদপ্তরও সেভাবে উদ্যোগ নেয়নি। সিটি করপোরেশন যারা এসবের লাইসেন্স দেয় বা তদারকি করে, তারাও সেটা সঠিকভাবে করেনি।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এসব এলাকায় অধিকাংশ মালিকই বাড়ি ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল। অনেক ভবন মালিকই আছেন যারা ভবন নির্মাণ করেছেন অগ্রিম ভাড়ার টাকা ও ব্যাংক লোনে। অন্য কোনো আয়ের উৎস না থাকায় তারা এসব ভবন গোডাউন বা কারখানা হিসেবে ভাড়া দেন। সেসব কারখানা বা গোডাউন দাহ্য পদার্থের হলেও সে বিষয়ে তারা উদাসীন। আবার ওয়ার্ড কমিশনার ও জনপ্রতিনিধিরাও স্থানীয় এসব বাসিন্দাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাসায়নিক গোডাউন সরিয়ে নিতে চাপ দিতে পারেন না। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও রহস্যজনক কারণে এ অনিয়মগুলো দেখেও না দেখান ভান করছে।

এছাড়া এই এলাকার রাসায়নিকের গোডাউন অপসারণের যে কোনো উদ্যোগেই প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ান স্থানীয়রা। তাই গত ১২ বছরে বড় ধরনের দুটি অগ্নিকাণ্ডের পরও একটি গোডাউনও সরানো যায়নি। তবে স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, সরকার কঠোর হলে সবকিছুই সম্ভব। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পঞ্চায়েত ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

এদিকে চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছিল। কিন্তু সেটিরও কোনো সুরাহা হয়নি। আগুনের ঘটনার পর নিহতদের পরিবারকে দাফনের জন্য শুধু ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এরপর আর কোনো টাকা পাননি তারা। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। এমন পরিবারগুলোর অনেকেই ঢাকায় থাকতে না পেরে গ্রামে চলে গেছেন বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

অন্যদিকে এই আগুনের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে ওয়াহিদ ম্যানশন থেকে আগুনের সূত্রপাত সেই ভবন মালিকের দুই ছেলে হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ জামিনে মুক্ত আছেন। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের তারিখও পেছানো হচ্ছে বার বার। পুলিশ বলছে, গোডাউনের অন্য মালিকদের ঠিকানা নিশ্চিত হতে না পারায় তাদের এখনো আইনের আওতায় আনা যায়নি।

পুরান ঢাকা নিয়ে গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েরর অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ। তার মতে, ২০০১ সালের হিসাবে পুরান ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ বসবাস করে। এখানকার প্রায় প্রতিটি ভবনেই রয়েছে রাসায়নিক কারখানা, গোডাউন কিংবা অন্য কোনো ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রতি মুহূর্তে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা ঘনবসতির পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানো না হলে আবারো বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।