ট্রলিম্যান থেকে কোটিপতি

আপেল মাহমুদ। ২০০৭ সালে চাকরি করতেন রাইফেলস স্কয়ারে অ্যাগোরা সুপারশপে ‘ট্রলিম্যান’ হিসাবে। সেই আপেল মাহমুদ আজ চড়েন বিলাসবহুল গাড়িতে। গরিব-অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করায় ‘দানবীর’ হিসাবেও এলাকায় তার বেশ খ্যাতি রয়েছে।
জানা যায়, রাজধানীর মিরপুরের মল্লিকা হাউজিংয়ে তার রয়েছে ফ্ল্যাট। সাভারের আমিনবাজারের লোহার ব্রিজ এলাকায় রয়েছে এক একরের বেশি জমি। রাজধানী ঢাকাসহ নিজ এলাকায় নামে-বেনামে ও স্ত্রী শিউলী আক্তারের নামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। ওয়ান-ইলেভেনের পর ২০০৯ সালে পটপরিবর্তন হতেই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের সান্নিধ্য পান আপেল মাহমুদ। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্ষমতাসীন নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে শুরু করেন তদবির বাণিজ্য। জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণ চোরাচালানের সিন্ডিকেটের সঙ্গে। স্বর্ণ পাচারে ‘বডি ক্যারিয়ার’ হিসাবে কাজ করেন। পরে মেজর অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের নামে মালয়েশিয়া থেকে আমদানিকৃত হিমায়িত খাদ্যপণ্য মহিষের মাংসের প্যাকেট এবং মাছের পেটে স্বর্ণ-মাদক কারবার করে বনে গেছেন শতকোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর করা লিখিত অভিযোগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আপেল মাহমুদের আয়কর নথির ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আয়-ব্যয় বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নগদ টাকা সাত কোটি ৭৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮০০ টাকা, ইসলামী ব্যাংকে এফডিআর ৫২ লাখ ৩৫ হাজার ২২২ টাকা, স্বর্ণ ১৫ ভরি, ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দামের একটি গাড়ি (নম্বর-গ-২১-১৫০২), মেজর অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডে শেয়ার ৩৬ লাখ ও ইভার গ্রো লিমিটেডের শেয়ার ছয় লাখ টাকা, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জামপুরে ২০ শতক আবাদি জমি, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার খাগড়াবাড়িয়া মৌজায় ৫৯৭৪ নম্বর দাগে ২.৪৬ শতক, ৬৫৬৭ নম্বর দাগে ২.৪৬ শতক, ২৮৬৫ নম্বর দাগে ৪.৯১ শতক ও একই উপজেলার সোনাডাঙ্গা মৌজায় ১৯০ নম্বর দাগে ৩৯ শতক এবং ওড়াকান্দি মৌজায় ৯৩.৩৩ শতক জমি রয়েছে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরের মল্লিকা হাউজিংয়ে ফ্ল্যাট, সাভারের আমিনবাজার এলাকায় এক একরের বেশি জমি, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘বোস্টন বাটস’ নামে একটি রেস্টুরেন্টসহ গোপালগঞ্জের খাগড়াবাড়িয়া ও ওড়াকান্দি বিলে আপেল মাহমুদের নামে-বেনামে তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পদের আয়ের উৎস ও বিবরণী আয়কর ফাইলে উল্লেখ করেননি তিনি।
সোনারগাঁয়ের ২০ শতক জমির মূল্য ৭৮ লাখ টাকা দেখালেও তার বাজার মূল্য রয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। এতে তার অর্থ-সম্পদের হিসাবে গরমিল ও তথ্য গোপনের অভিযোগ রয়েছে। অ্যাগোরার ট্রলিম্যান হিসাবে শূন্য হাতে জীবন শুরু করা আপেল এখন শতকোটি টাকার অর্থ-সম্পদের মালিক। আপেল মাহমুদ আইন পেশায় জড়িত থাকলেও তার দৃশ্যমান তেমন কোনো ব্যবসা নেই। খাগড়াবাড়িয়া গ্রামে প্রায় ২৭০ শতাংশ জমির ওপর ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন বিশাল কারখানা। তার বিরুদ্ধে ওই গ্রামের দিনমজুর ইলিয়াস মোল্লা ও তপন মোল্লার বসতবাড়ি দখলচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ভুক্তভোগী ইলিয়াস মোল্লা ও তপন মোল্লার বাড়ির চারপাশে আরসিসি পিলারের দেওয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এতে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে পরিবার দুটি।
নাম প্রকাশ্য অনিচ্ছুক খাগড়াবাড়িয়া গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, ‘আপেল মাহমুদ এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ। আগে কী ছিল, আর এখন কী হয়েছে এলাকার সবারই জানা।’ কাশিয়ানী উপজেলার খাগড়াবাড়িয়া গ্রামের দিনমজুর মৃত হোসেন আলী মিয়ার ছেলে আপেল মাহমুদ। তার বাবার তেমন কোনো জায়গা-জমি ছিল না। কৃষি কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে আপেল মাহমুদ অঢেল সম্পদের মালিক হন। গরিব-অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করায় ‘দানবীর’ হিসাবেও তার এলাকায় বেশ খ্যাতি রয়েছে।
এলাকায় তার নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী রয়েছে। তার বাহিনীর কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে কাশিয়ানী থানাসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে মামলা রয়েছে। এদিকে, সাভারের আশুলিয়ায় জুলাই গণহত্যার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে আশুলিয়া থানার একটি হত্যা মামলায় আপেল মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে। মামলা নম্বর-৩৭/৩৯৭।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আপেল মাহমুদের মুঠোফোনে কথা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি অভিযোগের কপি হাতে পেয়েছি। তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার এ ধরনের কোনো সম্পত্তি নেই। তবে ঋণে কেনা আমার একটা গাড়ি আছে।’