অভিজাত এলাকাকে ঘিরে স্পার আড়ালে অনৈতিক কারবার

রাজধানীতে সবশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বর গুলশানে একই সঙ্গে ৩টি স্পা সেন্টারে অভিযান চালিয়েছিল থানা পুলিশ। স্পা সেন্টারগুলো হলো- ম্যাঙ্গো স্পা, লাইভ স্টাইল হেল্থ ক্লাব অ্যান্ড স্পা সেুলন, রেডিডেন্স সেলুন-২ অ্যান্ড স্পা। এরপরই অনেকটা থমকে গিয়েছিল রাজধানীতে স্পার আড়ালে অনৈতিক কারবার। তবে এর মাস দুয়েক পর থেকে আবারো যেন জেঁকে বসেছে।
বিশেষ করে গুলশান, বনানী, নিকেতন, উত্তরার অভিযাত এলাকাকে টার্গেট করেই যেন গড়ে উঠেছে এ অনৈতিক কারবার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেকে ব্যবহার করে লোভনীয় বিজ্ঞাপণ দিয়ে কাস্টমারদের আকৃস্ট করা হচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, অভিযাত ও কূটনৈতিক জোনে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নিয়ে এ ধরনের অসামাজিক কার্যকালাপ সত্যিই অবাক করার মত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেই এটি বন্ধ করতে পারে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে করেনা। এছাড়াও এই কারবারকে পূঁজি করে নানা ব্ল্যাকমেইলিংয়েরও ঘটনা ঘটে।
তবে গুলশান থানার ওসি (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম বলছেন, আমরা মাঝে মধ্যেই এ স্পা সেন্টারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করি। পরে আবারো বাসা পরিবর্তন করে ব্যবসা চালু করে। আবারো স্পার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হবে। এ জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গুলশান, বনানী, নিকেতন ও উত্তরায় প্রায় দেড়শতাধিক স্পা সেন্টার রয়েছে। যারা স্পায়ের নামে এ অনৈতিক কারবারে লিপ্ত।
কয়েকটি স্পা সেন্টার ঘুরে দেখা যায়, ভিতরে ঘরগুলোতে ছোট ছোট ঘরের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে কেবিন। যেখানে বাইরে থেকে ভিতরে কি হচ্ছে তা কোনোভাবেই বোঝার উপায় নাই। বিভিন্ন রংয়ের আলোয় ঝলমল করছে স্পা সেন্টারগুলো। বাইরে থেকে ভিতরের পরিবেশ অনুমান করা খুবই কঠিন। ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে ছিমছাম পরিপাটি সেলুন। অথচ এর মধ্যে চলছে ভয়ঙ্কর অনৈতিক কর্মকান্ড। বাহিরের দিকটায় পর্দা টানিয়ে ভিতরে ঢুকলেই দেখা মিলবে স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটি পড়ুয়া সুন্দরীদের আনা গোনা। এখানেই চলে যতসব অনৈতিক কর্মকান্ড। স্কুল-কলেজের উঠতি বয়সী ছেলেরাসহ যুব-সমাজের একটি বড় অংশ এদের খদ্দের।
গুলশান - বনানী কেন্দ্রীক এধরনের অসংখ্য স্পার আড়ালে চলছে মাদক ও অসামাজিক বাণিজ্য। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের বিরুদ্ধে গুলশান বিভাগের ডিসি বরাবর কয়েকবার অভিযোগ করা করলে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। কয়েকটি মানব পাচার মামলাও হয়। তবুও অসামাজিক কার্যকালপ থেমে নেই।
স্থানীয় পাশের ফ্ল্যাটের একজন জানান, এখানে এমন অনৈতিক কাজ হয় তা সবাই জানে। কিন্তু পুলিশ তাদের কিছু বলে না। অসামাজিক এসব পার্লার থেকে পুলিশের কিছু কর্মকর্তা মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়।
সূত্র জানায়, খদ্দেরদের আকর্ষণ বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারও চালাচ্ছে তারা। সেখান থেকেই ফোন নাম্বারের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়। কোনো রকমের সন্দেহ হলেই ভুল ঠিকানা দিয়ে এড়িয়ে চলা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গুলশান রোড নং ১২৩ এর হাউজ নং ২১ থার্ড ফ্লোরে মেঘলা ও তাজু যৌথভাবে এ অনৈতিক কারবারে জড়িত । গুলশান-১ জব্বার টাওয়ারের ৯ম তলায় হাসির নিয়ন্ত্রাণাধীন এরোমা থাই স্পা। গুলশান -১ নাভানা টাওয়ারের ২২ তালায় ফারিয়ার স্পা। কিছুদিন আগেও এই ফারি কে আটক করেছিল পুলিশ। জামিনে বেরিয়ে আবারো এ ব্যবসা শুরু করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত এ সিন্ডিকেটটি সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে। গুলশান, বনানী, উত্তরা এবং নিকেতন এলাকায় যে সকল বাসা বাড়িতে এ অনৈতিক কারবার চলে তার মূলেই এ সিন্ডিকেট কাজ কওে বলে জানা যায়।
তবে গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ্ত চক্রবর্তী বলেন, অবৈধ স্পা বা ম্যাসাজ পার্লারের নাম যারা অসামাজিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। আমরা বারবারই এর বিরুদ্ধে অভিযানে যায়। কিন্তু ছাড়া পেয়ে আবারো স্থান পাল্টিয়ে ওই ব্যবসা শুরু করে। আমরা দ্রুত অভিযানে যাচ্ছি বলেও জানান তিনি।
উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার শহিদুল্লাহ বলেন, উত্তরা এলাকায় এ ধরনের অনৈতিক কারবারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছি। আবারো যদি এ ধরনের কারবার চলে আমরা অভিযান পরিচালনা করবো।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার জন্য কাজ শুরু হচ্ছে। কোনভাবেই এ ধরনের অনৈতিক কারবারীদের ছাড় দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ফেসবুকে বিজ্ঞাপণ : ‘আওয়ার থেরাপিস্ট ইজ ইয়াং... অ্যান্ড সো হট।’ বাংলায়, ‘আমাদের থেরাপিস্টরা কচি এবং খুব আকর্ষণীয়।’ গুলশানের অ্যারোমা থাই স্পা’র প্রিন্ট বিজ্ঞাপন এটি। নিজেদের ফেসবুক পেজে স্পন্সর বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রচারণা এমন! বিজ্ঞাপনটিতে গ্রাহকদের দুই ধরনের ম্যাসেজ দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘নুরু ম্যাসেজ’ ও ‘বডি টু বডি ম্যাসেজ’। আরও লেখা আছে, ‘উই হ্যাভ নিউ ফোর গার্লস (আমাদের সংগ্রহে নতুন চারটি মেয়ে আছে)।’
ম্যাসেজ পার্লারের এমন বিজ্ঞাপনে ম্যাসেজ ছাড়াও স্পষ্টভাবে অন্যকিছুর ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে! ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, বিজ্ঞাপনে ‘নুরু ম্যাসেজের’ কথা উল্লেখ রয়েছে। নুরু ম্যাসেজ বলতে শরীরের সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে ম্যাসেজ করা বোঝায়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জনপ্রিয়। ‘বডি টু বডি ম্যাসেজ’ তার চেয়েও ভয়ংকর, এটি অনেকেরই জানা।
শুধু অ্যারোমা নয়, ঢাকা শহরে তাদের মতো প্রায় ডজনখানেক স্পা সেন্টার অশ্লীল বিজ্ঞাপন আর মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশে বডি ম্যাসেজের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অথচ তাদের কাছে নেই কোনো বৈধ কাগজ কিংবা ট্রেড লাইসেন্স। সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে হোটেল, বিউটি পার্লার, সেলুন আর ব্যায়ামাগারের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে চলছে এ ব্যবসা, চলছে অশ্লীলতা।
পরিচয় গোপন করে সেবাগ্রহীতা সেজে কথা হয় গুলশানের স্পা জোন’র কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। গুলশান-১ এর ডিসিসি মার্কেটের বিপরীতে একটি ভবনে সেন্টার তাদের। কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এখানে বয়সভিত্তিক বিভিন্ন ক্যাটাগরির ১০-১২ জন মেয়ে দিয়ে ম্যাসেজ করানো হয়। বয়স ছাড়াও ম্যাসেজে পারদর্শী ও অপারদর্শীদের আলাদা ক্যাটাগরি রয়েছে। ইউনিভার্সিটিপড়ুয়া কম বয়সী মেয়েরাও আছে। যদি কেউ প্রশিক্ষিত মেয়েদের নিয়ে সারা শরীর ম্যাসেজ করাতে চান তাহলে খরচ পড়বে ঘণ্টাপ্রতি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। যদি এক ঘণ্টা ফুল কাজ করেন তাহলে পড়বে পাঁচ হাজার। ভালো ক্যাটাগরির আকর্ষণীয় মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ছয় থেকে সাত হাজার পড়বে।’
পুলিশের ঝামেলা হবে না তো? জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো সমস্যা নাই, আমাদের সব বৈধতার কাগজ আছে। আমরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করি, নিয়মিত মাসোয়ারা দেই। কোনো সমস্যা নাই।’
কথা হয় গুলশানের ব্লু ট্যারেস স্পা নামের একটি স্পা অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টারের কর্মকর্তার সঙ্গে। তারা সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে বিউটি সেলুনের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে পরিচালনা করছে ম্যাসেজ সেন্টার, করছেন অসামাজিক কার্যকলাপ!
ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ‘ভালো মেয়েদের দ্বারা’ বডি ম্যাসেজ করা হয়। ঘণ্টায় তিন থেকে চার হাজার টাকা লাগে। এখানে ‘ফুল কোর্সও’ রয়েছে, রেট সাত থেকে ১০ হাজার টাকা।
একই চিত্র গুলশান-বনানী এলাকার গুলশান সেলুন অ্যান্ড স্পা, লেটস রিল্যাক্স স্পা, ঢাকা গুলশান স্পা, ফেমাস স্পা’র। অশ্লীলতার ইঙ্গিত দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে তরুণ ও বয়স্ক পুরুষদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
ঢাকা গুলশান স্পা’র একটি বিজ্ঞাপনে স্পা’র সঙ্গে ‘কমপ্লিট ফান’র ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পোস্ট করা হয়েছে অশ্লীল ভিডিও।
এদিকে বেশ কয়েকবার স্পা’র নামে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা ঘটিয়েছে কয়েকটি স্পা সেন্টারে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্পা'র নামে অসামাজিক কাজ করে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে গুলশান ও বনানী এলাকার ডব্লিউ বিউটি অ্যান্ড স্পা, মহাখালী ডিওএইচএস-এর ফনিক্স হেলথ কেয়ার, গুলশানের হোয়াইট বিউটি সেলুন অ্যান্ড স্পা সেন্টার এবং ডায়মন্ড বিউটি অ্যান্ড স্পা’য় অভিযান চালিয়ে ৪০ জনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের বিরুদ্ধে তরুণীদের দিয়ে স্পা করানোর পর সেসময়ের ছবি ধারণ করে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ ছিল।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারীতে এগুলোও থাকে। যদি কেউ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রতারিত বা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হন তবে আমাদের নিকট অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারবো।