ভাষা ও বাঙালিত্বের টানেই ওপার থেকে এসেছেন তারা

সংস্কৃতি, ভাষা ও আত্মীয়তার টানে এবারো কলকাতা থেকে সাইকেলে চালিয়ে এসেছেন তারা। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবেন তারা। বাংলা কখনও হয় না ভাগ, বাংলা ভাষায় আমরা এক’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কলকাতা থেকে ৫০০ কিলোমিটার পথ সাইকেলে পারি দিয়ে ঢাকায় এসেছেন তারা ১৮ জন। গেল ৮ বছর ধরে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তারা। এপার-ওপার বাংলার মেলবন্ধনকে আরওসুদৃঢ় করতে বয়সের বাধা মানেননি তারা। এই দলটিতে ৬৮ বছরের বৃদ্ধ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণও রয়েছেন। বাঙালিত্বের টানেই বয়স ও ক্লান্তিকে দূর করে তারা এসেছেন ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। এবারের ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রস-বর্ডার মৈত্রী সাইকেল র্যালিটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দিন ঢাকায় এসে পৌছায়। তারা সকালে ফুল দিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাবেন। এরপর রাতের দিকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হবেন তারা।
এই গ্রুপটির টিম লিডার স্বরজিৎ রায়। গ্রুপে সুদীপ্ত পাল, লোপামুদ্রা রয়, বুদ্ধদের দাস, অমিত কুমার দত্ত, সুজয় ম-ল, সুখেন্দ্র ব্যানার্জি, বিপ্লব কুমার দত্ত, তপন কুমার রয়, হরিদাস মৈত্র, আসাদুল ম-ল, রবীন্দ্রনাথ হালদার, রামেস চন্দ্র সরদার, তরুণ কায়াল, সৌমিয়া জৈতি হালদার, সোমনাথ ব্যানার্জি ও চন্দন সরকার।
২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে তারা বাংলাদেশে আসেন। তবে ২০১৫ সালে আসা হয়নি। এই গ্রুপটির লিডার স্বরজিৎ প্রতিবারই এসেছেন। তিনি নতুন সময়কে বলেন, প্রথমে শুধু র্যালি হিসেবে আসতাম। তবে এখন ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মীয়তার টানে ছুটে আসি। আগামী বছর ২১ সালে আমরা ২১ জন আসব বলে পরিকল্পনা করেছি।
তিনি বলেন, ধর্ম, রাষ্ট্র ও জাতি নিয়ে আমরা জন্মাই। ধর্ম ও রাষ্ট্র চাইলেই পরিবর্তন করা যাবে। কিন্তু জাতি নয়। আমরা চাইলেই বাঙালিত্ব পরিবর্তন করতে পারব না। এটি মনে রাখতে হবে। আর এই বাঙালিত্বের কারণেই প্রতি বছর আমরা আসি।
সুদীপ্ত পাল বলেন, বর্ডার দিয়ে আমাদের বিভক্ত করা হয়েছে। কিন্তু দু’দেশের ভাষা-সংস্কৃতি এক। আসলে এই দিনটিকে সম্মান জানাতেই আমরা এখানে ছুটে আসি।
৬৬ বছর বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ হালদার। ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার টানেই এসেছি। আমার কোন ক্লান্তি নেই। আমি চাই জার্মানির মতো বাংলাদেশ ও কলকাতা হোক। জার্মানির দু’ভাগ যেমন এক হয়ে গেছে, তাদের যেমন কোন ভিসা লাগে না, শুধু পাসপোর্ট হলেই হয়, আমি চাই আমার জীবদ্দশায় যেন এমনটা দেখতে পাই।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলার বিভিন্ন রকম ব্যবহার দেখা যায়। ব্যবসার খাতিরে ভাষাটাকে পাল্টানো হচ্ছে। অনেক সংবাদপত্র এমনটা করছে। ভাষার বিকৃতি করা উচিত নয়।
এই গ্রুপটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তরুণ কায়াল। ২৯ বছরের এই তরুণ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ঘুরার খুব শখ। এ কারণেই এখানে আসা। পুলিশ খুব ও রোটারি খুব সহায়তা করেছে। আগামী বছরও আসার ইচ্ছা আছে। আমি চাই বাংলা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাক।
এই গ্রুপের বয়োজ্যেষ্ঠ তপন কুমার রায়। ৬৮ বছরের এই মানুষটি ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তবে তার চেহারায় ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। এবারের মতো ২০১৭ ও ২০১৮ সালেও তিনি একইভাবে এসেছিলেন। তিনি বলেন, আনন্দের কারণে কোন ক্লান্তি নেই। ভাষার টানে আমি এখানে আগের মতো এবারো ছুটে এসেছি। এর মাধ্যমে দুই বাংলার মেলবন্ধন আরও দৃঢ় হবে।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতার প্রেসক্লাব থেকে যাত্রা শুরু করেন তারা।
কলকাতার মন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্লা ও সুব্রত মুখার্জি এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। বারাসাত, বেনালী, মুজিবনগর, কুষ্টিয়া রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ হয়ে গতকাল সাভারে পৌঁছান। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো শেষে বিকেলে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ঘুরে দেখেন তারা।
দলটির পক্ষ থেকে দাবি ও আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ১৯৬৪ সালের ১ মে শিলচরে ১১ জন ভাষার জন্য প্রাণ হারিয়েছেন। তার মধ্যে একজন কমলা ভট্টাচার্য। ভাষার জন্য প্রাণ হারানো তিনিই একমাত্র নারী। আমরা চাই ওইদিনে বাংলাদেশ থেকেও একটি প্রতিনিধি দল যাক। এছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তার্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই বাংলাদেশ থেকেও এমন একটি প্রতিনিধি দল কলকাতায় যেতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
এই র্যালিটির দুটি অংশ। প্রথম অংশ শুরু হয় ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে। বিরসিংহ গ্রাম থেকে শুরু হয় প্রথম পর্বের কার্যক্রম।
গ্যাংগ ‘ভাষা সূত্র’ নামের এই মৈত্রী সাইকেল র্যালিটি ভারত ও বাংলাদেশের পর্যটন করপোরেশন ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা স্পন্সর করেছে। এই গ্রুপে ৭১ বছর বয়স্ক একজন এবং একজন নারীও রয়েছেন। তারা অবশ্য সাইকেলিং করেননি। গতবছর ২১ জন এসেছিলেন। এর আগের বছর এসেছিলেন ২৩ জন।