গাইবান্ধায় বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি তিনশো কোটি টাকা

গাইবান্ধা জেলার প্রায় ছয় লাখ মানুষ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। টানা ১৫ দিন পানিবন্দি থাকার পর মানুষজন তাদের ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তবে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে এসব মানুষ। দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া, পায়ে ঘাঁ, সর্দি জ্বরসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ ব্যাধি। অবশ্য জেলা প্রশাসন চাল, শুকনো খাবারের প্যাকেট, শিশু খাদ্য, গো-খাদ্য এবং স্থানীয় ধনী ব্যক্তিরা চাল-ডাল, রান্না করা খাবারসহ শুকনো খাবার বিতরণ করে আসছে বানভাসিদের জন্য। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
এদিকে বানভাসিদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে জেলায় ১০৯টি মেডিকেল টিম গঠন করা হলেও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা ও ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন আশ্রয়ণ কেন্দ্রের আশ্রিত মানুষরা।
২০১৯ সালের এই বন্যাকে সরকারের কাছে গাইবান্ধার বিভিন্ন মহল দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি দুষছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। সচেতন মহলের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলার কারণে শহর রক্ষা বাঁধের কয়েকটি পয়েন্ট ধসে যায়। হু-হু করে পানি ঢুকে শহরের বেশ কিছু এলাকার রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যায়। বাসা বাড়িতে হাঁটু পরিমাণ পানি হয়। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়ে শহরবাসী। তারা আরো বলেন, শুকনো মৌসুমে পাউবো বাঁধগুলো মেরামতে কোনো উদ্যোগ নেয় না। শুধু বন্যার সময় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে কোমড় বেধে ভাঙন রোধের চেষ্টা করে। কিন্তু গাইবান্ধাবাসী শেষ রক্ষা পায় না। কোটি কোটি টাকা লুটপাটের উদ্দ্যেশেই তারা সাড়া বছর নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।
স্মরণকালের এই ভয়াবহ বন্যায় গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৩৭টি পয়েন্টে দেড় কিলোমিটার ভেঙে যায়। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০ কিলোমিটার বাঁধ।ফলে জেলার সাত উপজেলার ৪৯টি ইউনিয়নের ৪২৪টি গ্রামের প্রায় ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। পানিতে ডুবে মারা যায় নয়জন। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় তিনশো কোটি টাকার বাঁধ-রাস্তা-ব্রীজ ও কালর্ভাট। ফলে গাইবান্ধা জেলা শহরের সাথে কয়েকটি উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এছাড়া গাইবান্ধার ত্রিমোহিনী-বাদিয়াখালী-বোনাড়পাড়া পর্যন্ত রেলপথ প্রায় একহাজার ফুট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।ফলে গাইবান্ধার সাথে ঢাকার সরাসরি রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
কৃষিখাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাত হাজার ৫২০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ধরনের ফসল। এতে ৯২ কোটি এক লাখ ১৭ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। পাশাপাশি মৎস্য খাতেও ৬ হাজার ২৯০টি পুকুর ও খামারের মাছ ভেসে যায়। এতে অবকাঠামোগত সহ ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আব্দুদ দাইয়ান বলেন, এবার ভয়াবহ বন্যায় জেলায় পাঁচ হাজার চাষির ৭৬০ হেক্টর জমির ৬ হাজার ২৯০টি পুকুর ও খামারের ২ হাজার ৬০ মেট্রিক টন ছোট বড় মাছ এবং এক কোটি ১১ লাখ মাছের পোনা ভেসে গেছে। এতে প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এছাড়া অবকাঠামো গত ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ কোটি ছয় লাখ টাকা। পুকুর ও খামারগুলো হলো,গাইবান্ধা সদর উপজেলায় এক হাজার ২০৫টি, পলাশবাড়িতে ১৭৫টি, গোবিন্দগঞ্জে ৫১২টি, সাঘাটায় তিনহাজার ৪ টি, ফুলছড়িতে এক হাজার ২০৮ টি, সুন্দরগঞ্জে ৪৮ টি ও সাদুল্যাপুরে ১৩৮টি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গাইবান্ধার উপ-পরিচালক এসএম ফেরদৌস বলেন, ভয়াবহ বন্যায় সাত উপজেলায় রোপা আউশ ২৩৯০ হেক্টর, পাট ১৬১২ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ২৪৭১ হেক্টর, রোপা আমন ৩১ হেক্টর, বিভিন্ন ধরনের সবজি ৯৭১ হেক্টর, পান ৩ হেক্টর এবং অন্যান্য ৪৩ হেক্টরসহ মোট ৭ হাজার ৫২০ হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯২ কোটি এক লাখ ১৭ হাজার টাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৩৭টি পয়েন্টে দেড় কিলোমিটার ভেঙে গেছে এবং ৫০ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
তিনি আরো বলেন,গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে এবং শহরের ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এলজিইডি’র গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম সেখ বলেন, জেলায় বন্যায় ১৬১টি রাস্তায় ৩৭৬ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মেরামত কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬২ কোটি টাকা। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ২২টি ব্রীজ-কালর্ভাট মেরামতে ব্যয় হবে ১৩ কোটি সহ মোট ৭৫ কোটি টাকা।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশাদুজ্জামান বলেন, বন্যায় ৮০ কিলোমিটার রাস্তা এবং তিনটি ব্রীজ-কালর্ভাটের ৫০ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৬০ কোটি টাকা।
গাইবান্ধার সিভিল সার্জন এবিএম আবু হানিফ বলেন, বন্যা দুর্গত এলাকায় জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ১০৯টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, বিলিচিং পাউডার, স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধপত্র পর্যাপ্ত রয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসার এনায়েত হোসেন বলেন, বন্যায় জেলায় ১৯৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে চার কোটি ৫২ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা র্কমকর্তা মো. হোসেন আলী মুঠোফোনে বলেন, বন্যায় এগারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বেশকিছু বিদ্যালয়ের আংশিক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষয়-ক্ষতির টাকার পরিমাণ বলতে পারেননি তিনি।
জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বানভাসি মানুষদের জন্য ১১০টি আশ্রয়ণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ৮৯৮ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।