ঢাকা সোমবার, ২৩শে জুন ২০২৫, ৯ই আষাঢ় ১৪৩২


সাইনবোর্ডে ঝুলছেন চেম্বারের ডাক্তার!


৩১ জানুয়ারী ২০১৯ ০৪:৪৬

সাইনবোর্ডে ঝুলছেন চেম্বারের ডাক্তার!

কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে এসেছেন রবিউল ইসলাম নামের ৫০ বছর বয়সের এক ভদ্রলোক। দীর্ঘদিন থেকে পেটের পীড়ায় ভুগতে থাকা রবিউল রাজধানীর মিরপুরে থাকা এক আত্মীয় বাসায় এসে উঠেছেন। স্থানীয় চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকার গ্যাস্ট্রোএন্টেরলজি বিশেষজ্ঞ কোন ডাক্তারকে দেখাতে। গত সপ্তাহের বুধবার সন্ধ্যায় সেই আত্মীয়ের সাথে মিরপুরের একটি ডায়গনোস্টিক সেন্টার যান তিনি। সেন্টারের বাইরে ঝুলানো সংশ্লিষ্ট বিভাগের জনৈক এক অধ্যাপকের সাইনবোর্ড দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উনাকে দেখাবেন। সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর রবিউলকে জানানো হল এই অধ্যাপক আসতে পারছেন না, তবে নিরাশ হওয়ার কারণ নেই। আছেন বিকল্প একজন, যিনি  গ্যাস্ট্রেএন্টেরলজিতে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের লক্ষে কোন একটি কোর্সে ভর্তি হয়েছেন মাত্র। নিরুপায় রবিউল একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই দেখালেন সবেমাত্র কোর্সে ভর্তি হওয়া অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সেই চিকিৎসককে।

‘একজন প্রফেসর লেভেলের ডাক্তার দেখাতে আসছিলাম। কিন্তু পারলাম না। এই ডাক্তারেরও আচার-ব্যবহার ভালো। কিন্তু মনেতো সন্তুষ্টি পাচ্ছিনা ভাই। ভাবছি আগামীকাল আরো কাউকে দেখাবো। এত কষ্ট করে ঢাকা এসে যদি মনটাকে বুঝ দিতে না পারি, তাহলে রোগ সারবে কিভাবে? নতুন সময়ের সাথে আলাপকালে অসন্তুষ্টিতে ভুগতে থাকা রবিউল বলছিলেন কথাগুলো।

তবে নতুন সময়কে সন্তুষ্ট করতে আজগুবি সব কথা-বার্তা বলা সেই ডায়গনোস্টিক সেন্টারের ম্যনেজার সুব্রত বললেন, ‘স্যার আমাদের এখানে অন-কল সার্ভিসে রোগী দেখেন। আজ রোগী কম দেখে তিনি আসেননি। তবে আমরাতো বিকল্প ডাক্তার দেখিয়ে দিয়েছি এই রোগীকে’।

খিলগাঁও এলাকার একটি হাসপাতালের বাইরে মাতুয়াইল শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালের প্রসূতী ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ জনৈক এক সহযোগী অধ্যাপকের সাইনবোর্ড দেখে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অন্য একজন চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে হয়েছে বাসাবো এলাকার বাসিন্দা দীপ্তিকে।

দীপ্তি বলেন ‘ম্যাডাম এখানে বসেন শুনে আসছিলাম। হাসপাতালের সাইনবোর্ডে ম্যাডামের নামও দেখলাম। সিরিয়াল দিয়ে প্রায় দেড়ঘন্টা বসিয়ে রেখে তারা বলল উনি ওটিতে আছেন, আসতে আসতে রাত ১১ টা বাজবে। তবে বিকল্প ব্যবস্থা নাকি আছে, সমমানের অন্য একজন ডাক্তারকে দেখিয়ে দিবে। বাসার কাছাকাছি অবস্থান হওয়ায় আর দ্বিমত না করে উনাকে দেখালাম। কিন্তু নতুন এই কনসালটেন্টের চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হতে পরিনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম উনি আল্ট্রাসনোগ্রাফীর উপর পড়ালেখা করেছেন। কিন্তু স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে তাকে চালিয়ে দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর ঐ সহযোগী অধ্যাপক নাকি গত ৩ মাস হয় এখানে বসেন না। অথচ হাসপাতালের রিসিপশনের লোকজন এটা স্বীকার না করে আমাকে উল্টো মিথ্যা বলেছে যে, ম্যাডাম ওটিতে আছেন’।    

যে ডাক্তার আপনাদের এখানে বসেন না, তার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন? নতুন সময়ের এমন প্রশ্নে হাসপাতালের রিসিপশনে থাকা দুই কর্মচারী জানান, ‘আমরা অনেকবার বোর্ড নামাতে চেয়েছিলাম, তবে এমডি স্যার নামাতে নিষেধ করেছেন। স্যার বলেছেন এই ডাক্তারের সাথে আলাপ হচ্ছে, উনি আবার আসতে পারেন এখানে। আপাতত উনার রোগীদেরকে অন্য ডাক্তার দেখিয়ে আটকে রাখো। রোগী হাতছাড়া হয়ে গেলে নতুন করে আবার জমাতে সময় লাগবে। তাই আমাদের এই বিকল্প ব্যবস্থা। 

যাত্রাবাড়ির আরেকটি হাসপাতালের মালিকতো সরাসরি স্বীকারই করে নিলেন যে উনার হাসপাতালের সাইনবোর্ডে নাম থাকা ১৫ জন ডাক্তারের মধ্যে মাত্র ২ জন বসেন এখানে। বাকিরা কোনদিনই আসেননি এখানে। মুখে মুখে নাম বা গল্প শুনে, অথবা কোথাও ভিজিটিং কার্ড পেয়ে বোর্ডে ঝুলিয়ে দিয়েছেন তাদের নাম। 

এসময় সাইনবোর্ডে নাম থাকা ৩ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে ফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওখানে সাইনবোর্ডে তাদের নাম লেখা আছে শুনে হতবাক তারা। বললেন, আমরাতো চিনিই না এই হাসপাতালটা।

কেন করছেন এমন প্রতারণা? নতুন সময়ের প্রশ্ন ছিল যাত্রাবড়ির এই হাসপাতালটির মালিকের কাছে। তার উত্তর, ‘মানুষ কত বড় বড় আকাম করে, সেগুলো আপনার চোখে পড়ে না! আমার পিছনে লাগলেন কেন ভাই! আমিতো অন্য ডাক্তার দেখিয়ে দেই রোগীকে। টাকা নিয়েতো আর ডাক্তার না দেখিয়ে ফেরত পাঠাইনা কাউকে’। 

সরেজমিনে রাজধানীর অনেকগুলো চিকিৎসা প্রতিষ্টান ঘুরে এমন সব তথ্য পেয়েছে নতুন সময়। সাইনবোর্ডে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম লেখা অথচ হাসপাতালে একজন ডাক্তারও নেই। ডায়গনোস্টিক সেন্টারে সাইনবোর্ডে, গত ছয় মাস বা বছর ধরে চেম্বার করেননা এমন চিকিৎসকের নাম ঝুলছে অহরহ। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার এমন কয়েকজন চিকিৎসকের নাম লিখে রেখেছে, যে চিকিৎসকরা জীবনে কখনো এখানে বসেননি, এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানের নাম পর্যন্ত শুনেননি। ভূঁইফোড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অনেক নামী-দামী হাসপাতাল-ডায়গনোস্টিক সেন্টারও এই কাজ করছে হরদম।

নতুন সময়ের সাথে আলাপ হয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)’র সহকারী রেজিস্টার ডা: মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক ফরাজী সোহেলের। এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো রোগীদের সাথে সরাসরি প্রতারণা। আর প্রত্যেক প্রতারণাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে ডাক্তার আপনার প্রতিষ্ঠানে বসেননা, তার নামে প্রচারণা চালানো মানে তার নাম বিক্রি করে নিজে লাভবান হচ্ছে আপনি। তার রোগীরা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে, অথবা সিনিয়র ডাক্তারের নাম দেখে রোগী আসবে বেশি বেশি, এমনটা চিন্তা করাও অপরাধ। আমরা অভিযোগ পেলে অভিযানসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করি প্রায় সময়’।

তবে বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং-এর আওতায় আনা উচিত বলে অভিমত বিএমডিসি’র এই কর্মকর্তার। 

নতুন সময়/এসইউএ/এআই