দুদকের পলাতক ৭০ আসামির নাম যাচ্ছে ইন্টারপোলে

রেড নোটিশ জারির জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে কমপক্ষে ৭০ জন আসামীর নাম যাচ্ছে আর্ন্তজাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলে। এরা প্রত্যেকেই দুদকের মামলায় আসামী এবং জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পলাতক আছেন। ইতিমধ্যে রেড নোটিশ জারির জন্য আসামীদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করছে দুদক। তথ্য সংগ্রহের পর যাচাইবাছাই শেষে পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে ইন্টারপোলের কাছে পাঠানো হবে।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকভাবে দুদক প্রায় ৭০ জনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। তাদের মধ্যে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি মামলার ২৫, হলমার্ক গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ১৭, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ৯, প্যারাগন গ্রুপের এক, টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সের দুই ও ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৬ আসামী রয়েছেন।
তারেক রহমানসহ পলাতক আসামীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশিদ আলম বলেন, ‘তারেক রহমানসহ কয়েক আসামীকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর অগ্রগতির বিষয়ে মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।’
বিদেশে থাকা পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকসহ বিভিন্ন মামলার অনেক আসামী বিদেশে অবস্থান করছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাদেরকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদেরকে আসামীদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে কমিশনে জমা দিতে বলা হয়েছে। তথ্য পাওয়ার পর সেগুলো যাচাই বাছাই শেষে কমিশনের অনুমোদনক্রমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে ইন্টারপোলে পাঠানো হবে।
একই বিষয়ে দুদকের অপর পরিচালক মীর মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন শিবলী বলেন, পলাতক আসামীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে তিনটি শাখা কাজ করছে। এরমধ্যে রয়েছে মানিলন্ডারিং শাখা, বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখা এবং অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখা। মোট কয়জন আসামী পলাতক আছে সেটা বলা মুশকিল। তবে এবিষয়ে কাজ চলছে। তিনি আরও বলেন, যেসব পলাতক আসামীদের সাজা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ দিতে হবে আদালতের মাধ্যমে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দুদক কাজ করছে।
দুদকের কর্মকর্তারা জানান, বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মামলায় ২০১৫ সালে ১৫৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৫৬টি মামলা করা হয়। এসব আসামীদের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ জন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এসব আসামীদের পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ও আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করার পর ইন্টারপোলে পাঠানো হবে। তালিকায় থাকা আসামীদের মধ্যে আছেন ব্যাংকটির সাবেক এমডি ফখরুল ইসলাম, ব্যাংকটির শান্তিনগর শাখার সাবেক প্রধান ও জিএম মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিতে সম্পৃক্ত অটো ডিফাইনের মালিক ওয়াহিদুর রহমান ও তার স্ত্রী।
জনতা ব্যাংক থেকে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বিসমিল্লাহ গ্রুপ ১২ শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ১২ টি মামলা করে দুদক। এ সব মামলায় পলাতক আসামিরা হলেন বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী ও খাজা সোলায়মানের স্ত্রীর এবং গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাবিব, বিসমিল্লাহ গ্রুপের পরিচালক ও খাজা সোলেমানের বাবা সফিকুল আনোয়ার চৌধুরী, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকবর আজিজ মুতাক্কি, মহা-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবুল হোসেন চৌধুরী, ব্যবস্থাপক রিয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, নেটওয়ার্ক ফ্রেইট সিস্টেম লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আক্তার হোসেন এবং জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা মোস্তাক আহমদ খান এবং এস এম শোয়েব-উল-কবীর। গত ১০ সেপ্টম্বর একটি মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০-এর বিচারক আতাবুল্লাহ আসামীদের ১০ বছর করে কারাদন্ড দেন। এসব আসামীদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
এছাড়া ভুয়া নথিপত্র দিয়ে সোনালী ব্যাংকের ৩৪২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জিনাত ফাতেমা। তারা আগেই মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। এই মামলায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে রেড নোটিশ দেয়া হচ্ছে। একই ব্যাংকের ৬০৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্যারাগন নিট অ্যান্ড কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল হাসান রাজার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনিও বর্তমানে পলাতক।
দুদক সূত্র জানায়, হলমার্ক গ্রুপের মামলায় ১৭ আসামি পলাতক রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিং মিলসের মালিক আ. বাছির, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. জিয়াউর রহমান, আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলম, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক ও সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার। আরও আছেন সোনালী ব্যাংক হোটেল রূপসী বাংলা শাখার সহকারী উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন ও সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি, প্রধান কার্যালয়ের জিএম অফিসের জিএম ননী গোপাল নাথ, প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবির, সাবেক ডিএমডি মাইনুল হক, বরখাস্ত হওয়া দুই এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান ও এজাজ আহম্মেদ।
এদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির বিষয়ে কাজ করছে দুদক। এর আগে সিঙ্গাপুরে ২০ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং ও একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। কিন্তু কয়েকদিন পরই তা তুলে নেয় ইন্টারপোল। এবিষয় ইন্টারপোলের বক্তব্য ছিলো তারেক রহমান ‘প্রোটেক্টিভ স্ট্যাটাস’-এ আছেন। নতুন করে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির বিষয়ে দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশিদ আলম বলেন, ‘দুর্নীতির মামলা সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে আমরা আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছি। নোটিশ ইস্যু করা হবে কি হবে না এটা আমাদের বিষয় নয়।’
রাজধানীর বনানীর ডিসিসি সুপার মার্কেট হাউজিং কমপ্লেক্সের বেইজমেন্টে কার পার্কিং ইজারায় দুর্নীতির দায়ে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয় আদালত। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার মামলায় আরও ১৩ বছরের সাজা দেয়া হয় সাদেক হোসেন খোকাকে। তার রিরুদ্ধেও রেড নোটিশ যাবে দুদকের পক্ষ থেকে।
অপর দিকে নাম স্বর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দেয়ার মামলায় ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের (বর্তমান আইসিবি ইসলামী ব্যাংক) পলাতক আছেন সাবেক ছয় কর্মকর্তা। তারা হচ্ছেন ব্যাংকটির সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মোহাম্মদ হারুন ও আবুল কাশেম আহমদ উল্লাহ, সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলুর রহমান ও মাহমুদ হোসেন, নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট কামরুল হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক ইমামুল হক এবং ব্যবসায়ী আবু বকর।
নতুনসময়/এসইউএ