চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ইনজেকশনে স্ত্রী হত্যার অভিযোগ

রাজধানীর বাসাবোতে চিকিৎসক স্বামীর উপর স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগটি যেনো ভারতীয় টেলিভিশনেরঅপরাধ বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘ক্রাইম পেট্রোল’কেও হার মানায়। সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ডাক্তার শাহীনুর ইসলাম তুষার (৪০) তার দ্বিতীয় স্ত্রী শিরিনার (৩৩) মরদেহ গোপনে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়িতে পাঠচ্ছিলেন। কিন্তু বাঁধ সাধেন রাস্তায় ডিউটিতে থাকা সবুজবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আরিফ আলী। তিনি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি আটক করেন। বিবর্ণ হওয়া লাশ দেখেই হত্যা বলে তার সন্দেহ হয়। পরে থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেন। ময়নাতদন্ত করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পুলিশ এখন ময়না তদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষা করছে। এঅবস্থায় ডাক্তার তুষার ও তার সহযোগিরা নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে শিরিনার ভাই, বড় ছেলে ও অন্যান্য আত্মীয়দের। তাদের আশঙ্কা তুষার চিকিৎসকদের প্রভাবিত করে ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাল্টে দিবেন।
শিরিনার বড় ভাই নূরুল ইসলাম জানান, তার বোন শিরিনা দেখতে বেশ সুন্দরী ছিলেন। মালিবাগের একটি ফার্মেসিতে তুষারের কাছে চিকিৎসার জন্য যান ১০ বছর আগে। ওই সময় শিরিনার আগের স্বামী গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস মিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো না। তুষারের কুদৃষ্টি পড়ে শিরিনার ওপর। সে নানাভাবে শিরিনাকে উত্যক্ত করতে থাকে। একপর্যায়ে তুষার তার আগের স্ত্রী ও সন্তানের তথ্য গোপন রেখে শিরিনাকে বিয়ে করে। বিয়ের পর তারা ১৭/২, মধ্যবাসাবোর বাসায় ভাড়া থাকতো। শিরিনা-তুষার দম্পতির কোন সন্তান নেই। তুষার প্রায়শই শিরিনাকে শারিরিক নির্যাতন করতো। তাকে বিয়ের পর প্রায় তিন বছর গ্রামের বাড়ি যেতে দেয়নি। এমনকি তার আগের ঘরের দুই সন্তানের সঙ্গেও দেখা করতে দেয়নি। দিনে দিনে তুষারের নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। কয়েক বছর আগে তুষার স্কুলে ভর্তির প্রলোভন দিয়ে শিরিনার দুই সান্তান সিয়াম (১৫) ও সিফাত (১১) বাসায় এনে আড়াই বছর বাসাবোর বাসায় আটকে রাখে।
নূরুল ইসলাম আরও বলেন, আমি মুর্খ মানুষ। হোটেল বয় হিসেবে কাজ করি। এতকিছু বুঝি না। তুষার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অপারেশনের আগে রোগী অজ্ঞান করার কাজ করে। সে আমার বোনকে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করেছে। হত্যার পর পুলিশকে না জানিয়ে গোপনে লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর চেষ্টা করে। সে আমারেদকে না জানিয়ে আমার চাচাতো ভাইকে ডেকে আনে। তাকে বাড়ির কারো সঙ্গে কথা না বলার জন্য হুমকি দেয়। পরে পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে শিরিনার লাশ উদ্ধার করে। মাত্র আড়াই ফুটের একটি গামছা গলায় পেঁচিয়ে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার একজন নারী কিভাবে আত্মহত্যা করনে পারেন? পুলিশ গামছাটি জব্দ করেছে। নূর ইসলামের আশঙ্কা, তুষার ডাক্তার হওয়ায় ঢামেকের চিকিৎসকদেরকে প্রভাবিত করে ময়না তদন্ত রিপোর্টে ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করবে। ফলে তারা ন্যায় বিচার বঞ্চিত হবেন। তিনি আরও জানান,থানা পুলিশ মামলা না নিলে তারা আদালতে মামলা করবেন বলেও জানান।
শিরিনার চাচাতো ভাই কবির বলেন, ‘তুষার ফোন করার পর আমি তুষারের সঙ্গে বাসায় যাই। তুষার নিজেই চাবি দিয়ে দরজা খুলেছে। বাসার দরজা ভাঙার কোন আলামত দেখিনি। বাসায় বেড রুমের ওপর খাটের মধ্যে একটি কাঁথা দিয়ে ডাকনা দেয়া অবস্থায় পড়েছিলো শিরিনার লাশ। তার কাছে তুষার বলেছেন দারোয়ান জলিল ও তিনি লাশ ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়েছেন। অথচ দারোয়ান জলিল প্রথমে জানান তিনি গিয়ে লাশ খাটের ওপর দেখেছেন। আবার বলছেন তিনিসহ নামিয়েছেন। তুষার নিজেই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে এনে লাশ বরগুনায় পাঠানোর চেস্টা করেন।
শিরিনার মরদেহ উদ্ধার করেন সবুজবাগ থানার এসআই আরিফ আলী। তিনি বলেন, ‘১০ জানুয়ারি আমি টহল ডিউটিতে ছিলাম। এসময় একটি লাশবাহী গাড়ি দেখে সন্দেহ হয়। গাড়িটি থামিয়ে ভিতরে একজন নারীর লাশ পাওয়া যায়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তার স্বামী ডাক্তার তুষার জানান, তার স্ত্রী শিরিনা আত্মহত্যা করেছেন। তার লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তুষার জানিয়েছেন ‘গামছা পেঁচিয়ে শিরিনা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আমরা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছি যার নম্বর-২, তারিখ ১০ জানুয়ারি ২০১৯। যে গামছা দিয়ে আত্মহত্যার দাবি করা হচ্ছে ওই গামছাটি পানিতে ভিজানো অবস্থায় আমরা জব্দ করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে তুষার জানিয়েছেন তিনি দারোয়ানসহ দরজাখুলে বাসায় প্রবেশ করে লাশ নামিয়েছেন।’ আরিফ আলী আরও বলেন, আমরা লাশের ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়েছি। প্রতিবেদন পাওয়ার পর হত্যা না আহত্মহত্যা নিশ্চিত হওয়া যাবে। ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলে অপমৃত্যুর মামলাটিই হত্যা মামলা হিসেবে গণ্য হবে।’
সুবজবাগ থানা পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিরিনার মুখমন্ডল, নাক, কান, দাঁতসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক ছিলো। কোমর, পিঠসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে রক্ত জমাট বাঁধা ছিলো। সম্পুর্ণ পা রক্ত জমাট বাঁধা ও কালো অবস্থায় ছিলো। প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যার কথা বলা হলেও নিহতের শরীরে বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমাট বাঁধা ও নীল হয়ে যাওয়ার কারন নির্ণয়ে ময়না তদন্ত প্রয়োজন।
শিরিনার বড় ছেলে সিয়াম জানান, তার সৎবাবা তুষার প্রায়শই তার মাকে মারধর করতো। তাদেরকে এই বাসায় আসতে দিতো না। তারা মায়ের বাড়ি বরগুনার আমতলী উপজেলার গাজীপুর মোল্লাবাড়িতে নানার সঙ্গে থাকে। তার মা কিছু দিন আগে তাদের নামে একটু জমি কেনার জন্য নানা বাড়িতে গিয়ে ৮ ভরি গহনা ও জমি বিক্রির সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে আসেন। ওই টাকার জন্য সৎবাবা তুষার তাকে নির্যাতনের পর ইনজেকশন হিয়ে হত্যা করেছে।
শিরিনার ময়নাতদন্তকারি চিকিৎসক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, লাশের ময়না তদন্ত হয়েছে। প্রতিবেদন থানায় পাঠানো হবে। হাসপাতালের নাম প্রকামে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, সাধারণত শরীরে বিষক্রিয়া থাকলে নীল হবে এবং রক্ত জমাট বেঁধে যাবে। শিরিনার ক্ষেত্রেও এমনটা সন্দেহ করা হচ্ছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
শিরিনার আত্মীয়রা জানান, ‘ডাক্তার তুষারের বাবার নাম রফিক। তুষার মালিবাগের পিপলস হাসপাতালে প্রাইভেট রোগী দেখেন। তুষারের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রূপসদী গ্রামে। ঢাকায় মধ্য বাসাতো থাকেন। তুষারের প্রথম স্ত্রী আয়েশা ১০ বছরের মেয়ে আলো ও ৫ বছরের ছেলেসহ রংপুরে থাকে। তুষার তাদেরও খোঁজ খবর নেন না।’
বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে স্ত্রী শিরিনা হত্যার অভিযোগ বিষয়ে ডা. শাহীনুর তুষারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে। তিনি এখন ওটি (অপারেশন থিয়েটার) তাই কোন কথা বলতে পারবেন না। পরবর্তীতে আরও কয়েক দফা তাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করে ওটি’তে আছেন বলে জানান।
/এসইউএ