এলডিসি উত্তরণ ও চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে যা বললেন তারেক রহমান
স্বল্পন্নোত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ এবং চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে কথা বলেছেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট ছাড়াই সরকার চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে; গতি এবং 'অনিবার্যতার' নামে বৈধ উদ্বেগগুলিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। জাতীয় জীবনকে গঠনকারী সিদ্ধান্তগুলি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকারের নেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাতে সামাজিক মাধ্যম নিজের ভেরিফাইড ফেসবুকে এ সংক্রান্ত পোস্টটি করেন। সেখানে তিনি উদাহরণ টেনে এলডিসি উত্তরণ ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রসঙ্গে বিশদ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
তারেক রহমান লিখেছেন, গাজীপুরের এক ছোট গার্মেন্টস মালিককে কল্পনা করুন। এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি কারখানা গড়ে তুলেছেন—শতাধিক শ্রমিকের বেতন সামলান, কম লাভে টিকে থাকেন এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করেন। হঠাৎ করেই কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক দাম ধরে রাখার শুল্ক-সুবিধা বিলীন হয়ে যায়। এতে করে অর্ডার কমে আসে, আর বাড়তে থাকে চাপ, কারখানা টিকিয়ে রাখা, শ্রমিকদের বেতন দেয়া, পরিবারকে নিরাপদ রাখা যেন সবই কঠিন হয়ে ওঠে।
এবার ভাবুন নারায়ণগঞ্জের এক তরুণীকে। তিনি দেখছেন, তার পরিবার অনিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে। তার বাবা একটি কারখানায় কাজ করেন; সংসার চলে ওভারটাইমের টাকায়। রফতানির চাপ বাড়লে প্রথমে বন্ধ হয় ওভারটাইম, তারপর কমে শিফট, শেষে আসে ছাঁটাই। এগুলো কোনো সংবাদ শিরোনাম নয়। এগুলো সাধারণ পরিবারের নীরব সংকট।
এই সিদ্ধান্ত নিতে তারা কোনো ভোট দেয়নি। কেউ তাদের জিজ্ঞেসও করেনি। প্রকৃত সংখ্যাগুলোও তাদের দেখানো হয়নি। তাই বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ নিয়ে বিতর্ক সরকারি বিবৃতির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিএনপি আগে থেকেই বলছে, ২০২৬ সালে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় ঠিক রেখে স্থগিতের বিকল্প খোলা না রাখার মতো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার, যার কোনো নির্বাচনী ম্যান্ডেট নেই। তারপরও এই সরকার এমন দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে দশকের পর দশক প্রভাবিত করবে।
কিন্তু আমাদের বলা হচ্ছে, সময় বাড়ানো ‘অসম্ভব’; স্থগিতের অনুরোধ করাটাও ‘অপমানজনক’। জাতিসংঘ নাকি তা বিবেচনাই করবে না। কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা।
অ্যাঙ্গোলা ও সামোয়ার মতো দেশ তাদের উত্তীর্ণ হওয়ার সময় সংশোধন করেছে। জাতিসংঘের নিয়মই বলে, কোনো দেশ অর্থনৈতিক ধাক্কায় পড়লে এই সময় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে এমন সিদ্ধান্তে সময় চাওয়াটাই একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ হওয়া উচিত।
তাহলে কেন আমরা ভান করছি যে, আমাদের কোনো বিকল্প নেই? কেন আমরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ সীমাবদ্ধ করছি?
স্থগিতের বিকল্প প্রকাশ্যে বন্ধ করে দিয়ে আমরা নিজেরাই আলোচনা করার ক্ষমতা দুর্বল করছি। আন্তর্জাতিক আলোচনায় আমরা প্রভাব খাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করে আগেই দুর্বল অবস্থান থেকে টেবিলে বসছি।
সরকারের নথিতেই স্বীকার করা হয়েছে, ব্যবসায়ীরা ব্যাংকখাতে চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, ঋণের ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং রফতানি মন্থর হয়ে যাওয়ার প্রভাব অনুভব করছেন। এটা এলডিসি উত্তরণে বিরোধিতা নয়। বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার অধিকার অর্জন করেছে। কিন্তু ‘অধিকার’ থাকা আর ‘প্রস্তুত’ থাকা এক বিষয় নয়।
প্রকৃত জাতীয় শক্তি হচ্ছে এমন কঠিন প্রশ্ন করার সাহস, যাতে ভুল সিদ্ধান্ত অপরিবর্তনীয় হয়ে ওঠার আগেই সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়।
এবার নজর দিন চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার। সেখানে যা হয় তার প্রভাব লাখো মানুষের জীবনে অনেক গভীর প্রভাব ফেলে।
বন্দরকে ঘিরে সাম্প্রতিক দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তগুলো কোনোভাবেই রুটিন কাজ নয়। এগুলো জাতীয় সম্পদ নিয়ে কৌশলগত অঙ্গীকার—যা একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বেঁধে দেয়ার মতো করে এগিয়ে নিচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে যা দেখা যাচ্ছে, তা এলডিসি উত্তরণের মতোই—কৌশলগত বিকল্প সংকুচিত, জনআলোচনাকে ঝামেলা হিসেবে দেখা, যুক্তিসঙ্গত উদ্বেগকে ‘অনিবার্যতা’র নামে পাশ কাটিয়ে দেয়া হচ্ছে।
একটা বিষয় স্পষ্ট করে বলি, এটি কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণ নয়। এটি প্রতিষ্ঠান রক্ষা এবং সেই নীতি রক্ষা করার প্রশ্ন—দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে সেই সরকার, যার জনগণের কাছে জবাবদিহি আছে।
কেউ বলছে না যে আমাদের এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হওয়া উচিত নয় বা বন্দর সংস্কার করা উচিত নয়। যুক্তিটা খুবই সহজ ও মৌলিক, একটি দেশের ভবিষ্যৎ এমন সরকারের হাতে বন্দি থাকা উচিত নয়, যাকে এই জাতি নির্বাচিত করেনি।
কৌশলগত ধৈর্যধারন কোনো দুর্বলতা নয়। এমনকি জনপরামর্শ কোনো বাধা নয়। গণতান্ত্রিক বৈধতা কোনো বিলম্ব নয়। এটাই হয়তো এসবের পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য।
বাংলাদেশের মানুষ কখনোই ভবিষ্যৎ নিয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল না। তারা সম্মান, মত প্রকাশের অধিকার ও পছন্দের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে বলেই ত্যাগ স্বীকার করেছে। তাদের দাবিও সহজ—তাদের কথা শুনতে হবে, অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, সম্মান দিতে হবে।
পোস্টের শেষে তিনি লিখেছেন, পোস্টের শেষে তিনি লিখেছেন, আর ঠিক এ কারণে অনেকেই তাকিয়ে আছি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের দিকে। কারণ, এটাই বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার, নির্বাচিত করার এবং এই সহজ সত্য পুনর্ব্যক্ত করার সুযোগ যে, ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ এই বিশ্বাসকে ধারণ করে এ দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে এ দেশেরই মানুষ।'
