ঢাকা শনিবার, ২৩শে আগস্ট ২০২৫, ৯ই ভাদ্র ১৪৩২


চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে ‘বিপজ্জনক’ তিন শতাধিক কনটেইনার


২৩ আগস্ট ২০২৫ ১০:০৯

সংগৃহিত

চট্টগ্রাম বন্দরের শেড ও ইয়ার্ডে বছরের পর বছর পড়ে আছে আমদানি হওয়া বিপজ্জনক পণ্যের তিন শতাধিক কনটেইনার। খালাস না হওয়া এসব পণ্য নিলামে তুলতে পারেনি কাস্টমস। আবার ধ্বংসও করা হয়নি। এসব কনটেইনারে রয়েছে রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয়তার মতো বিপজ্জনক পণ্য। এসব কনটেইনার দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।

২০২০ সালের ৪ আগস্ট লেবাননের বৈরুত বন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওই দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হন। বিপজ্জনক রাসায়নিক থেকে ঘটনাটি ঘটে।


২০২২ সালের ৪ জুন রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরায় বিএম ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। সেই দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৩ কর্মীসহ ৫১ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন দুই শতাধিক। অগ্নিনির্বাপণ করতে সময় লেগেছিল চার দিন। আগুনের তাপে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের রাসায়নিকের কনটেইনার বিস্ফোরণে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি ডিপোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকা, রাসায়নিক মজুতের কারণে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দর বিপজ্জনক পণ্য সরাতে তৎপর হয়ে উঠেছিল। তখন তালিকা তৈরি করে কিছু পণ্য ধ্বংস করা হয়। আরও কিছু পণ্য নিলামে বিক্রি করা হয়। ওই সময় জটিলতার কারণে কিছু বিপজ্জনক পণ্য থেকে যায়। সেইসঙ্গে বছর বছর আরও অনেক বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনার জমা হয়। তবে জমা হওয়ার তুলনায় বিপজ্জনক পণ্য অপসারণে তোড়জোড়ে আর গতি দেখা যায়নি।


সীতাকুণ্ডের মতো বন্দরে বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলেও বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনার থেকেও আগুন ও বিস্ফোরণের নজির আছে। ২০২২ সালের ১৩ মে বন্দর চত্বরে থাকা ব্যাটারি ও ইলেকট্রনিক পণ্যবাহী একটি কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে ব্যাটারি পণ্য ও ইলেকট্রনিক পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর আগে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল রাতে বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল চত্বরে কনটেইনার খুলে কাভার্ডভ্যানে মিথানলভর্তি ড্রামবোঝাই করার সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে চার জন শ্রমিক আহত হন। তাদের শরীরের সামান্য অংশ পুড়ে যায়। আবার একই বছর নাইট্রিক অ্যাসিডভর্তি চারটি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া নির্গত হয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।

আগে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটলেও মূলত সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের পরদিন ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাস্টমসকে চিঠি দেয়। তাতে বিপজ্জনক পণ্য আছে, এমন জরাজীর্ণ ৫৯টি কনটেইনার ধ্বংস বা নিলামে তুলে অপসারণের কথা বলা হয়। এর পরদিন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের দুটি কনটেইনার নিলামে তুলে বিক্রি করে কাস্টমস। পরবর্তীতে এর ধারাবাহিকতা আর দেখা যায়নি।


সবশেষ গত ৬ আগস্ট ব্রাজিল থেকে চার বন্দর ঘুরে বন্দরে আসা এক কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যায়। বন্দরে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণের ব্যবস্থা ‘মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ রেডিয়েশন ডিটেকটিভ সিস্টেমে’ এটি শনাক্ত হয়। এরপরই কনটেইনারটির খালাস স্থগিত করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কনটেইনারটিতে রয়েছে স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরা। তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্রে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় কনটেইনারের অভ্যন্তরে তিনটি রেডিওনিউক্লাইড আইসোটোপের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই তিনটি হলো থোরিয়াম ২৩২, রেডিয়াম ২২৬ ও ইরিডিয়াম ১৯২।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পাওয়া গেছে এক মাইক্রোসিয়েভার্টস (তেজস্ক্রিয়তা থেকে যে বিকিরণ হয় তার একক)। এটি উচ্চ মাত্রার নয়, তবে পরীক্ষার আগে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তার প্রকৃত মাত্রা কতটুকু। কারণ, লোহার টুকরা ও কনটেইনার ভেদ করে তেজস্ক্রিয়তার সঠিক মাত্রা আসে না। এজন্য সতর্কতা হিসেবে কনটেইনারটি আলাদা করে রাখা হয়।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের নথিতে দেখা যায়, ঢাকার ডেমরার রড তৈরির কারখানা আল আকসা স্টিল মিলস লিমিটেড ব্রাজিল থেকে পাঁচ কনটেইনারে ১৩৫ টন স্ক্র্যাপ আমদানি করেছিল। তেজস্ক্রিয়তা সংকেত পাওয়া কনটেইনার এই পাঁচটির একটি। ৩ আগস্ট বন্দরের জিসিবি টার্মিনালের ৯ নম্বর জেটিতে ‘এমভি মাউন্ট ক্যামেরন’ জাহাজ থেকে কনটেইনারটি বন্দরে নামানো হয়। এরপর বন্দরের ৪ নম্বর ফটক দিয়ে কনটেইনারটি খালাস নেওয়ার সময় মেগাপোর্টের যন্ত্রে তেজস্ক্রিয়তা থাকার সংকেত বেজে ওঠে।

তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া এমন আরও ১২টি কনটেইনার পড়ে আছে বন্দরে। সবমিলিয়ে ১৩টি। পাশাপাশি বিভিন্ন ইয়ার্ডে পড়ে আছে রাসায়নিকভর্তি ৩৫০টি কনটেইনার। এর মধ্যে অনেকগুলো ১০-১৫ বছরের পুরোনো। এগুলো নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে বেকায়দায় আছে কর্তৃপক্ষ। সেইসঙ্গে ঝুঁকিতে আছে বন্দরটি।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হওয়া ১৩টি কনটেইনার শেড ও ইয়ার্ডের বিশেষ স্থানে রাখা আছে। এগুলোর বেশিরভাগেই রয়েছে জিংক-অক্সাইড মিশ্রিত পদার্থ ও স্ক্র্যাপ লোহা। অপরদিকে দাহ্য পদার্থবোঝাই ৩৫০টি কনটেইনারও বিশেষ স্থানে রাখা আছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু রয়েছে ১০-১৫ বছরের পুরোনো। যাতে দাহ্য পদার্থের পাশাপাশি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, সালফেট, সালফিউরিক অ্যাসিড, থিনার, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, সোডিয়াম সালফেট, মিথানল, ইথাইল হেক্সানল, নাইট্রিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামাল, রং তৈরির কাঁচামাল, টেক্সটাইল কাঁচামালসহ নানা ধরনের রাসায়নিক পণ্য। যার বেশিরভাগই দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয় পণ্য। যা বন্দরের জন্য বিপজ্জনক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বশেষ একটি কনটেইনারসহ মোট ১৩টি কনটেইনার আছে, যেগুলোতে তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে। পাশাপাশি বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ আছে, এ রকম ৩৫০টি কনটেইনার আছে। যেগুলো বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে। তবে আগে আরও বেশি ছিল। বিপজ্জনক রাসায়নিকবোঝাই কনটেইনারগুলো দ্রুত খালাস করার জন্য কাস্টমসকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

দাহ্য পদার্থ এবং পুরোনো কনটেইনারগুলো খালাসের কাজ চলছে বলে জানালেন চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেন। তিনি বলেন, ‘গত ৩০ জুলাই ৪২টি পুরোনো কনটেইনার খালি করা হয়েছে। আরও ৫০টি এই মাসে খালি করা হবে। আশা করছি, পর্যায়ক্রমে এসব কনটেইনার খালি করতে পারবো আমরা। এগুলো দীর্ঘদিন বন্দরে রাখা আসলেই বিপজ্জনক।’

চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি সতর্কসংকেত পাওয়ার পর তেজস্ক্রিয়তার কনটেইনারটি খালাস স্থগিত করে আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। পরমাণু শক্তি কমিশনকে বিষয়টি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এসে সরেজমিন তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করবেন। এরপরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগেও তেজস্ক্রিয়তা পদার্থ থাকা কনটেইনার জব্দ করা হয়েছিল। সেগুলোর কয়েকটি থেকে সন্দেহজনক পদার্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক কনটেইনার এখনও রয়ে গেছে। পরমাণু শক্তি কমিশনের গাইডলাইন মেনে এসব পণ্য সরানো হবে।’