ঢাকা বুধবার, ৯ই জুলাই ২০২৫, ২৬শে আষাঢ় ১৪৩২


চসিকে চাকরি স্থায়ীকরণে ভয়াবহ অনিয়ম


৯ জুলাই ২০২৫ ১১:৩৫

সংগৃহীত

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) চাকরি স্থায়ীকরণে ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি স্থায়ী করা তিনজনের মধ্যে একজনের মূল পদ সহকারী স্যানিটারি পরিদর্শক এবং অপরজন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক। তবে তাদের স্থায়ী করা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য পরিদর্শক’ হিসাবে। মূল পদে স্থায়ী না করে বিধিবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি দেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। 

 

এর আগে সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) পদে ফেল করার পরও উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে একজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওই প্রকৌশলীর পদোন্নতি বাতিল করা হয়। 

 

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও চার শ্রমিককে পদোন্নতি দিয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলী করা হয়েছিল। এসব অনিয়মের প্রমাণও পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

 

সূত্র জানায়, ৩০ জুন ২৯৫ জন অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী করেছে চসিক। তাদের মধ্যে সরকারি শিক্ষক পদে ১৭৪ জন, প্রভাষক পদে ৭৮ জন, মেডিকেল অফিসার পদে পুরুষ ও মহিলা মিলে ৩০ জন, মেডিকেল কনসালট্যান্ট পদে ২ জন, স্বাস্থ্য সহকারী পদে ৮ জন এবং স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে ৩ জন। 

 

স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে যে তিনজনকে স্থায়ী করা হয়েছে তারা হলেন-আরিফুল হক চৌধুরী, ইয়াছিনুল হক চৌধুরী ও নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া। এদের মধ্যে শুধু আরিফুল হক চৌধুরীর মূল পদ স্বাস্থ্য পরিদর্শক। বাকি দুজনের মধ্যে ইয়াছিনুল হক চৌধুরী এতদিন সহকারী স্যানিটারি পরিদর্শক এবং মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। এসব সহকারীদের গ্রেড ছিল ১৬তম। 

 

গত ২৯ জুন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তিনজনকে স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে স্থায়ীকরণ করা হয়। তাদের মূল পদ ১৬তম থেকে ১৪তম গ্রেডে উন্নীত করা হয়। তবে আদেশে কৌশলে মূল পদ কিংবা নিয়োগকৃত পদ উল্লেখ করা হয়নি। 

 

চসিকের নিয়োগ বিধিমালার ৬৯ নম্বর তফশিলে উল্লেখ রয়েছে, স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। এই পদে পদোন্নতির মাধ্যমে ৩৩ শতাংশ এবং সরাসরি নিয়োগে মাধ্যমে ৬৭ শতাংশ জনবল নেওয়ার নিয়ম। শর্ত হচ্ছে পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সহকারী বা পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণকর্মী পদে ৭ বছরের চাকরি, কোনো স্বীকৃত বোর্ড হতে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট ও কোনো স্বীকৃত ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠান থেকে মেডিকেল টেকনোলজি (স্যানিটারি ইন্সপেক্টরশিপ) বিষয়ে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা প্রয়োজন। 

 

অপরদিকে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি এবং কোনো স্বীকৃত ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠান হতে মেডিকেল টেকনোলজি (স্যানিটারি ইন্সপেক্টরশিপ) বিষয়ে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা প্রয়োজন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সম্প্রতি ‘স্বাস্থ্য পরিদর্শক’ পদে স্থায়ী হওয়া ইয়াছিনুল হক চৌধুরী এবং নজরুল ইসলাম ভূঁইয়ার ক্ষেত্রে পদোন্নতি কিংবা সরাসরি নিয়োগের কোনো বিধি মানা হয়নি। 

 

জানা যায়, ইয়াছিনুল হক চৌধুরী ২০০৫ সালের ৩ আগস্ট ‘সহকারী স্যানিটারি পরিদর্শক’ পদে অস্থায়ী কর্মচারী হিসাবে চসিকে যোগ দেন। তবে চসিকের অর্গানোগ্রামে এই নামে কোনো পদ নেই। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য সহকারী পদে রয়েছেন, এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে ২০১২ সালে ইন্সপেক্টরশিপ ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। এছাড়া অস্থায়ী কর্মচারী হয়েও স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের মিথ্যা পদ দেখিয়ে হয়ে যান নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক। 

 

অপরদিকে ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল অস্থায়ীভিত্তিতে সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে যোগ দেন নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া। সেখান থেকে কাকতালীয়ভাবে ২০০৭ সালের ১০ জুন এক অফিস আদেশের মাধ্যমে তিনি স্বাস্থ্য পরিদর্শকের সহকারী হয়ে যান। ওই অফিস আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তবে স্বাস্থ্য সহকারী এবং স্যানিটারি ইন্সপেক্টরশিপ ডিপ্লোমা কোর্স ছাড়াই নজরুল ইসলাম ভূঁইয়াকেও করা হয়েছে স্বাস্থ্য পরিদর্শক।

 

এ ব্যাপারে চসিকের সংস্থাপন শাখার উচ্চমান সহকারী সঙ্গীতা দাশ বলেন, ‘স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে স্থায়ী হওয়া তিনজনের মধ্যে আরিফুল হক চৌধুরীর মূল পদ স্বাস্থ্য পরিদর্শক। বাকি দুজনের মধ্যে একজন সহকারী স্যানিটারি পরিদর্শক এবং অপরজন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক। স্থায়ীকরণের সময় তাদের মূল পদ উল্লেখ করেই কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছিল।’ 

 

চসিক স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদটি টেকনিক্যাল পদ। কারণ একজন স্বাস্থ্য পরিদর্শক চসিকের আওতাধীন হোটেল, বেকারি, রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করে ফুড লাইসেন্স প্রদান করেন। এছাড়া খাদ্য তৈরির সঙ্গে জড়িত কর্মচারীদের ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান এবং ইপিআই কার্যক্রম তদারকিও করতে হয়। এজন্য স্বাস্থ্য সহকারী হিসাবে ৫-৭ বছরের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক। তবে সম্প্রতি স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম কিংবা চাকরি বিধিমালার তোয়াক্কা করা হয়নি।’

 

চসিকের সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে চার শ্রমিককে পদোন্নতি দিয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলী করা হয়। বিষয়টি জানাজানির পর সোমবার চসিকে কার্যালয়ে অভিযান চালায় দুদক। অভিযানে এ অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। ২১ এপ্রিল চসিকের বিদ্যুৎ উপবিভাগের রূপক চন্দ্র দাশকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী থেকে সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। 

 

অভিযোগ ওঠে, পদোন্নতির মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য যে নম্বর দরকার, তা তিনি পাননি। এরপরও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ফেল করার অফিশিয়াল নথি ও পদোন্নতির আদেশ-এই দুই ফাইলেই চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের স্বাক্ষর ছিল। পরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে ১৫ মে রূপক চন্দ্র দাশের পদোন্নতি বাতিল করে চসিক। ঘটনা তদন্তে ২০ মে অভিযান চালায় দুদক। এতেও অনিয়মের সত্যতাও পায় সংস্থাটি।

 

চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে একটি কমিটি কাজ করেছে। অনেকদিন ধরে কমিটি যাচাই-বাছাই করেছে। সে অনুযায়ী স্থায়ী করা হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে মূল পদের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু গ্রেড একই রয়েছে। স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অভিযোগ পাইনি।’