ঢাকা শনিবার, ১১ই মে ২০২৪, ২৯শে বৈশাখ ১৪৩১


বাঙ্কার খুঁড়ে ভারি অস্ত্রের টহল


১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৪:১০

ফাইল ছবি

তৃতীয়বারের মতো মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি এসে পড়েছে বাংলাদেশে। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। গত শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সন্ধ্যার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড তমব্রু ঘোনার পাড়া এলাকায় একটি গুলি এসে পড়ে।

এদিকে সীমান্তের ওপারে বাঙ্কার খুঁড়ে ভারি অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত করছে মায়ানমার সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে তারা ভারি অস্ত্রের টহলও জোরদার করেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে।

সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে তুমুল গুলিবর্ষণ ও সংঘর্ষ চলছে। শুক্রবারও ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাইশফাঁড়ী বিজিবি বিওপির দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত পিলার ৩৬ এর বিপরীতে আনুমানিক তিন কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘর্ষ শুরু হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আনুমানিক ৪০০-৫০০ রাউন্ড ক্ষুদ্রাস্ত্র ফায়ারের শব্দ ও ২০-২৫টি মর্টার শেল ফায়ারের শব্দ শোনা যায়। এমন পরিস্থিতিতে বান্দরবানের সীমান্ত এখন আতঙ্কের জনপদে পরিনত হয়েছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘর্ষে এ জনপদটি এখন আতঙ্কের। বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে মর্টারশেল পড়া, হেলিকাপ্টার থেকে গুলি এসে পড়েছে। এসব ঘটনায় মায়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হলেও তা কোন কাজে আসছেনা। গত বুধবারও টানা গুলিবর্ষণে চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ আতঙ্কের মধ্যে সেখানকার কৃষকরাও জুমসহ তাদের কৃষি পণ্য ঘরে তুলতে পারছেনা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে আবারও গোলাগুলি শুরু হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে গুলি এসে পড়ে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। গত বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে গুলির শব্দ শোনা যায়। গোলাগুলির শব্দে সীমান্তের বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে।

তুমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা মাহামুদুল হক বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আবারও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শব্দগুলো বিকট; মর্টার শেলের আওয়াজ মতো। তবে আকাশে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান উড়তে দেখা যায়নি।

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তে দুই দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে আবারও গোলাগুলি শুরু হওয়ায় ভয়ে আছে সীমান্তের লোকজন। গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছে। শব্দগুলো বিকট। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এতে লোকজনের মাঝেও ভয়ভীতি বাড়ছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। শুক্রবারও গুলি এসে পড়ে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ফেরদৌস বলেন, তুমব্রু সীমান্তে রাখাইনে সকাল থেকে আবারও গোলাগুলি চলছে বলে স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের সীমান্ত বাহিনী কাজ করছে। সীমান্তের বাসিন্দাদের আতঙ্কিত না হতে বলা হচ্ছে।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার (এসপি) তারিকুল ইসলাম তারিক জানান, সীমান্তে প্রতিনিয়ত গোলাগুলির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে। সীমান্তে বসবাসকারীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সেনাবাহিনীর বারবার মর্টারশেল বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে গ্রামবাসী। বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে তাদের ঘরবাড়ি। আকাশ-সীমায় চক্কর দিচ্ছে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার।

তুমব্রু গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখানে খুব ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। প্রতিদিন আমাদের মাথার উপর দিয়ে গুলি বর্ষণ হচ্ছে। আমরা যেন গুলির নিচে অবস্থান করছি।

একই গ্রামের জাহিদ হোসেন জানান, তারা যেন যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন। প্রায়ই তাদের গ্রামের উপর দিয়ে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার যায়। গোলাবারুদের শব্দে বাচ্চারা আঁতকে উঠে। মাঝে মধ্যে সীমানার কাঁটাতারের ওপর পাশে মিয়ানমারে অস্ত্রধারী লোকজনকে দেখা যায়। কদিন আগেও তুমব্রু উত্তর পাড়ায় ২টা মর্টারশেল পাওয়া গেছে। যেগুলো মিয়ানমার থেকে এসে পড়েছে। এতে কারও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পরে বাংলাদেশের সেনারা এসব ধ্বংস করে। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তাটা কোথায়? এই বোমাগুলোত বিস্ফোরিত হতে পারত?’

আরেক গৃহবধু সাদিয়া বেগম জানান, প্রতিদিন এখানে বোম আর গুলির শব্দে আমাদের সন্তানেরা ভয়ে থাকে। ঘরের লোকজন আতঙ্কে কাজে যেতে চায় না। মনে হয় এই বুঝি মাথার উপর বোম পড়ল। পার্শ্ববর্তী দেশের এমন আচরণে আতঙ্কে থাকতে চাই না। আমরা এর সমাধান চাই।

তিনি বলেন, আমরা এক প্রকার ঘর থেকে বের হতে পারছিনা। জমি থেকে কোন ফসলও ঘরে আনতে পারিনা। জমিতেই ফসল নষ্ট হচ্ছে।

এসব ঘটনায় আতঙ্কে দিন পার করছেন সীমান্তের এপারে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের বাসিন্দারা। গত প্রায় একমাস ধরেই এ অবস্থা চলমান।

সীমান্তবাসী বলছেন, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির সঙ্গে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এ গোলাগুলি হচ্ছে। তারা একে অপরের উদ্দেশে মর্টার শেলসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। বর্তমানে সীমান্তের ভেতরে বাঙ্কার খুঁড়ে সেখানে ভারি অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে। ভারি অস্ত্র নিয়ে টহলও বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে আরাকান আর্মির সঙ্গে সন্মুখ গোলাগুলিও হচ্ছে।
তারা বলছেন, হেলিকাপ্টার দিয়ে গুলি করছে পাশাপাশি যুদ্ধ বিমান দিয়েও করা হচ্ছে। আর সেগুলো বাংলাদেশের আকাশ সীমাও লঙ্ঘন করছে।

সীমান্তের রেজুআমতলী, গর্জনবুনিয়া, বড়ইতলী সোনাইছড়ি ও আমতলীর বাসিন্দা, ক্যাচালনং তংচংগা, ফরিদুল আলম, মো. ইদ্রিস, উচালা মার্মা ও জোবেদা বেগমসহ অনেকে জানান, গত প্রায় একমাস ধরে মায়ানমার বর্ডারের দিকে বিকট গুলির আওয়াজ শুনতে পান তাঁরা। এমনকি মর্টারশেলের আওয়াজ তাঁদের আতঙ্কিত করে। সীমান্তের ৩৮ নম্বর পিলার থেকে ৪১ নম্বর পিলার পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকায় এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, আরাকান আর্মি নামক এক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংস্থা সেখানে অবস্থান করছে, যারা ওই এলাকা দখল করেছে। তাদের সাথে প্রতিনিয়ত মিয়ানমার আর্মির সংঘর্ষ হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তে এসে গোলা পড়া অনুচিত, এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আমাদের এখন দেখতে হবে গোলা পড়াটা ইচ্ছাকৃত নাকি তাদের সংঘর্ষের ফলাফল।
তিনি আরও বলেন, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, মিয়ানমার ইচ্ছাকৃত বাংলাদেশকে টার্গেট করে গোলাটা ছুড়ছে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সামরিক সক্ষমতা বজায় রেখে ভবিষতে যেন গোলা এসে না পড়ে, সে বিষয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে এটি সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের উচিত সীমান্তে আরো নজরদারি বাড়ানো। সামরিক উত্তেজনা বাড়ানো যত সহজ, নিষ্পন্ন করা ততটাই কঠিন।