কখনো কারাগার কখনো হাসপাতালে দিন কাটছে প্রভাবশালী সেই সম্রাটের

যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তারের পর বেশির ভাগ সময়ই হাসপাতালে থাকছেন। গ্রেপ্তারের পর একটানা ১১ মাস হাসপাতালে কাটিয়ে কারাগারে ফিরেছিলেন। তবে সেখানে বেশিদিন থাকা হয়নি। অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএসএমএমইউর প্রিজন সেলে সম্রাটের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চলছে। সেখানেই সারাদিন বিছানায় শুয়ে-বসে দিন কাটছে একসময়ের প্রভাবশালী এই নেতার। অসুস্থ থাকায় মামলার শুনানিতেও হাজির হতে পারছেন না। এতে বিলম্বিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর বিচারকাজ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি সূত্র জানায়, নানা ধরনের রোগে ভুগছেন সম্রাট। ১৯৯৮ সালে তার শরীরে একটি পেশমেকার লাগানো হয়। সেটার মেয়াদ ছিল ১৫ বছর। ২০১৩ সালে ওই পেশমেকারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এছাড়াও কিডনি, হার্ট, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের অসুখ নিয়ে বিএসএমএমইউর প্রিজন সেলে বন্দী রয়েছেন তিনি।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘সম্রাট বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের প্রিজন সেলে রয়েছেন। তিনি নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছেন।’ পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া সম্রাট হাসপাতালেই থাকবেন বলে জানান তিনি।
ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় র্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো চলার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর ৭ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সেদিন বিকালে সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে কাকরাইলের ভূইয়া ট্রেড সেন্টারে তার কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অভিযান শেষে ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ার কারণে সম্রাটকে তাৎক্ষণিকভাবে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। ঢাকার রমনা থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনে আরও দুটি মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে। পরে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং ও দুর্নীতির মামলাও হয়।
কোন মামলার কী অবস্থা
সম্রাটের বিরুদ্ধে দায়ের করা পাঁচটি মামলার মধ্যে তিনটিতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অস্ত্র ও মাদক মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে র্যাব। দুদকের করা অবৈধ সম্পদ অর্জন মামলায়ও চার্জশিট দেয়া হয়। সিআইডির করা অর্থ পাচারের মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। এছাড়াও বন্য প্রাণীর চামড়া রাখার অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।
অস্ত্র ও মাদক মামলায় সম্রাট ও তার সহযোগী যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা এনামুল হক ওরফে আরমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনর শুনানি পিছিয়েছে। সম্রাট অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকার কারণে শুনানি পেছানো হয়।
মাদক মামলায় ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। অভিযোগপত্রে বলা হয়, যুবলীগ নেতা সম্রাট জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তার সহযোগী আরমানের সহযোগিতায় তিনি মাদকদ্রব্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা মাদকদ্রব্যের কোনো বৈধ কাগজপত্র তিনি দেখাতে পারেননি।
ঢাকার দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাব পরিচালনা করতেন সম্রাট। তার নিয়ন্ত্রণেই এসব ক্লাবে ক্যাসিনোসহ জুয়ার আসর বসত। এভাবে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হন এই প্রভাবশালী নেতা। প্রতি মাসে ক্যাসিনো খেলার জন্য সিঙ্গাপুরেও যেতেন তিনি। সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করতেন। তার সহযোগী ছিলেন কাউন্সিলর মমিনুল হক ওরফে সাঈদ এবং যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া মদ ও ইয়াবার রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের কাছে মোট ১৯ বোতল বিদেশি মদ পাওয়া গেছে, যার দাম ৯৫ হাজার টাকা। আর জব্দ করা ইয়াবার দাম তিন লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় র্যাব। অভিযানে সম্রাটের কাকরাইলের কার্যালয়ে ক্যাঙারুর দুটি চামড়া, মাদক ও অস্ত্র পাওয়া যায়। এছাড়া এক হাজার ১৬০টি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় র্যাব বাদী হয়ে সম্রাটের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা করে।
এ ব্যাপারে ঢাকার সপ্তম মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আসামি সম্রাট অসুস্থ থাকায় এখন পর্যন্ত তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। ফলে এই দুই মামলার অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা যাচ্ছে না। তিনি ( সম্রাট) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় আদালত অভিযোগ গঠনের শুনানির নতুন দিন ঠিক করেছেন।’
এদিকে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানের মানিলন্ডারিং মামলায় তদন্ত এখনো শেষ করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই মামলায় প্রতিবেদন দেয়ার জন্য আগামী ৯ মে পরবর্তী দিন ধার্য করেছে আদালত।
২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রমনা থানায় মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ১৯৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলাটি করেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের উপ-পরিদর্শক রাশেদুর রহমান।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ইসমাইল চৌধুরী রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল এলাকায় অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ উপার্জন করে আনুমানিক ১৯৫ কোটি টাকা এনামুল হক আরমানের সহায়তায় সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন। আসামিদের বিদেশ গমনের তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, সম্রাট ২০১১-১৯ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে ৩৫ বার, মালয়েশিয়ায় তিন বার, দুবাইয়ে দুইবার এবং একবার হংকং ভ্রমণ করেছেন। একই সময়ে আরমান ২৩ বার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেছেন।
এ ব্যাপারে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলাটি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।’
২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম। সম্রাটের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৯৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনেন। মামলাটির তদন্তের দায়িত্বও পান ওই কর্মকর্তা। দুদকের করা এই মামলায়ও তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই মামলায় অনেক আগেই তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছি।’
এ ব্যাপারে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। আদালত খুললে ফোন করবেন, জেনে বিস্তারিত বলতে পারব।’