ঢাকা মঙ্গলবার, ২২শে জুলাই ২০২৫, ৮ই শ্রাবণ ১৪৩২


লকডাউন জেলায় জেলায় !


২৫ এপ্রিল ২০২১ ১০:৩৯

সংগৃহিত

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে নতুন করে আর কেন্দ্রীয়ভাবে সারা দেশে একসঙ্গে লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে না। তবে কোনো অঞ্চল বা এলাকায় করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতামতের ভিত্তিতে স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বা এলাকায় লকডাউন দিতে পারবে। করোনার সংক্রমণের হার ঝুঁকিমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত চলমান বিধিনিষেধ আংশিকভাবে অব্যাহত থাকবে। মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে পর্যায়ক্রমে তা আরও শিথিল করা হবে।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এসব বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যায়ক্রমে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, তবে কোনো কারণে সংক্রমণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে বা ভয়ংকর রূপ নিলে তখন কেন্দ্রীয়ভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। এর আগে নয়। তবে স্থাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয় না। স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে মাস্ক পরলেই অনেকাংশে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে চলমান বিধিনিষেধ আরও শিথিল করা হবে। তবে একেবারে তুলে দেওয়া হবে না। আংশিকভাবে বহাল থাকবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতিকে বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হোক এটা আমরাও চাই না। অর্থনীতির স্বার্থে আগামীতে আর কেন্দ্রীয়ভাবে সারা দেশে একসঙ্গে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে না। তবে সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শে স্থানীয় প্রশাসন কোনো অঞ্চল বা এলাকায় বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। প্রয়োজনে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এনজিওকর্মী ও স্থানীয়দের সহায়তা নেবে।

সূত্র জানায়, চলমান বিধিনিষেধ ২৮ এপ্রিলের পরও আংশিকভাবে বহাল থাকবে। তবে ২৯ এপ্রিল থেকে আরও শিথিল হবে। স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করার শর্তে ২৯ এপ্রিল থেকে গণপরিবহণ ও রেল সীমিত আকারে চালু হবে। জনসমাগমের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আপাতত খুলবে না। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম পর্যটন খাত পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া হবে। তবে শর্ত থাকবে কোনো পর্যটন স্থানে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা যাবে না।

বিধিনিষেধ শিথিল করার বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে সম্প্রতি করোনার সংক্রমণের হার কমে এসেছে। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ভিড় কমে এসেছে। মৃত্যুর হার কমে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাজের সুবিধার্থে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সূত্র জানায়, গত ৫ এপ্রিল থেকে চলছে টানা বিধিনিষেধ। চার ধাপে বাড়িয়ে তা শেষ হওয়ার কথা ২৮ এপ্রিল। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। এসব বিবেচনায় বিধিনিষেধ ইতোমধ্যে বেশ শিথিল করা হয়েছে। সব ধরনের আর্থিক সেবার কার্যক্রম সীমিত আকারে চলছে। আজ রোববার থেকে দোকানপাট ও শপিংমল সীমিত সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। আগামী ২৯ এপ্রিল থেকে ঈদের আগে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি আরও বাড়ানো হবে।

তবে সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কোনোক্রমেই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা যাবে না। এর মধ্যে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে মাস্ক পরাকে। সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কাজে স্থানীয় এনজিওসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে যুক্ত করা হবে। মানুষের মধ্যে এমন বার্তা দেওয়া হবে যে, মাস্ক না পরা মানে অপরাধ করা। রোগজীবাণুতে সহায়তা করা।

করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষকে সচেতন করতে ভারত সম্প্রতি এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করেছে। বাংলাদেশেও সেটি করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। করোনা প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করাই বড় কাজ। এটি সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, সবার অংশগ্রহণ জরুরি।

সূত্র জানায়, গত বছরও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে এলাকাভেদে লকডাউন দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল রাজধানীর রাজাবাজার ও ওয়ারী। এখন কোথাও সংক্রমণের হার বেশি হলে ওইসব স্থানেও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কোথায় কেমন বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

এর আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার স্বার্থে সারা দেশে একযোগে লকডাউন না দিয়ে সংক্রমণের মাত্রাভেদে অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। এর মধ্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান করোনার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে যেখানে সংক্রমণ সেখানেই লকডাউন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এজন্য তিনি একটি ‘স্মার্ট লকডাউন’ নীতিমালা তৈরি করে গত ১২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করেছেন।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান স্বাস্থ্য অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন সংগঠন ও পেশাজীবীদের জোট হেলদি বাংলাদেশের আহবায়কও। ওই মডেলে তিনি বলেছেন, সংক্রমণ রোধে অঞ্চল বা এলাকাভেদে লকডাউন আরোপ করা যেতে পারে। এর মধ্যে করোনা ছড়ায় এমন সব কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে বাকি সব সীমিত আকারে চালু রাখার প্রস্তাব করেন তিনি। একই সঙ্গে মানুষের যাতে ভিড় না হয় সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্যই তিনি স্মার্ট লকডাউনের প্রস্তাব করেছেন।

এদিকে ব্যবসায়ীরাও সব ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড খুলে দেওয়ার দাবি করে আসছেন। তারা বলেছেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একটির সঙ্গে অপরটি সম্পর্কিত। একটি খুললে অপরটি বন্ধ রাখলে সুফল মিলবে না। শিল্প কারখানা খোলা রাখা হয়েছে। এদিকে শিল্পের কাঁচামালের পুরান ঢাকার অনেক পাইকারি বাজার বন্ধ। ফলে কাঁচামালের অভাবে চালু কারখানাগুলো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে যেসব পণ্য তৈরি হচ্ছে, সেগুলো বিক্রি হচ্ছে কম। কারণ বিধিনিষেধের ফলে মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে পণ্য কিনছে কম। গণপরিবহণ, পর্যটন ও শিক্ষা খাত বন্ধ থাকায় এর সঙ্গে জড়িত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান বলেন, ব্যবসায়ীরা কখনোই সারা দেশে একসঙ্গে লকডাউন দেওয়ার পক্ষে নয়। কারণ এতে যেসব এলাকায় সংক্রমণ নেই ওইসব এলাকায়ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেখানে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে কেবল সেখানেই লকডাউন নিতে হবে। তাহলে একদিকে সংক্রমণ যেমন ঠেকানো যাবে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যও চলমান থাকবে। এতে এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় অনেক দেশ পুরো লকডাউন আরোপ করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ে তা করেনি। করোনায় বিপর্যস্ত এখন ভারত। তারাও দেশজুড়ে লকডাউন দেয়নি। যেখানে করোনার প্রকোপ বেশি সেখানে লকডাউন দিচ্ছে। অন্য স্থানে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতিতে চলছে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতেও একই অবস্থা। করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত হয়ে জার্মানি সীমিত আকারে লকডাউন দিয়েছিল। পরে তারা শিথিল করতে শুরু করেছে। আগামী ৩১ মে পর্যন্ত সীমিত আকারে সব চলবে। ১ জুন থেকে সব চলবে স্বাভাবিক গতিতে। ইউরোপের অনেক দেশই এখন এ গতিতে এগোচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের রপ্তানির বাজার ধরে রাখতে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও লকডাউন শিথিলের বিকল্প নেই।

এ প্রসঙ্গে একজন ব্যবসায়ী বলেন, এবারের লকডাউনে একদিকে শিল্পকারাখানা খোলা রেখেছে। ব্যাংক খোলা রাখা হয়, কিন্তু বীমা বন্ধ। বীমা ছাড়া তো আমদানি-রপ্তানি করা যাবে না।

পরে বিশেষ বিবেচনায় বীমা কোম্পানিগুলোও খোলা হয়। আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে শুধু ব্যাংক-বীমা নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানই জড়িত। ফলে সব খোলা না থাকলে এসব কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে।

একজন গার্মেন্ট এক্সেসরিজের ব্যবসায়ী বলেন, তিনি একটি গার্মেন্টে হ্যাঙ্গার সরবরাহ করেন। পুরান ঢাকা থেকে কাঁচামাল কিনে এগুলো তৈরি করেন। কিন্তু মার্কেট বন্ধ থাকায় তিনি কাঁচামাল কিনতে পারছেন না। ফলে হ্যাঙ্গারও সরবরাহ করতে পারছেন না। এতে তার কারখানা বন্ধ হয়েছে। গার্মেন্টেরও রপ্তানি বন্ধের পথে। এরকম প্রতিটিই ক্ষেত্রেই সমস্যা হচ্ছে।