ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


১৪ লাখ টন ঘাটতিতে অস্থির পিয়াজের বাজার


২৫ নভেম্বর ২০১৯ ২২:৫৩

সরকারি দপ্তরগুলোর হিসাবে পিয়াজের ঘাটতি সাত থেকে আট লাখ টন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবি এ ঘাটতি দ্বিগুণ। অন্তত ১৪ লাখ টন। আর এ কারণেই বাজারে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক হিসাবে ঘাটতি হলে বাজারে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। গতকাল রাজধানীর এফবিসিসিআই ভবনে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, মজুত, সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। ওই বৈঠক ঘাটতির তথ্য তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা দাবি করেন, যথা সময়ে ঘাটতি নিরুপন করে আমদানির উদ্যোগ নেয়া হলে বাজার পরিস্থিতি আরও সহনীয় থাকতো।

এফবিসিসিআই আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং কৃষি ও শিল্পমন্ত্রালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, এফবিসিসিআই’র সিনিয়র সহ সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পুরান ঢাকার পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের পিয়াজ আমদানিকারক হাজী মো. শহীদ ভুইয়া। তিনি বলেন, সভায় সরকারের অনেকেই বলেছেন দেশে পিয়াজের ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তব কথা হলো- শ্যামবাজারে কোনো দোকানে পিয়াজ নেই। সবগুলো দোকান মিলে দুই ট্রাক পিয়াজ বের হবে না। সভায় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, দুই একদিনে মধ্যেই পিয়াজের দাম কমবে। কিন্তু বাজারে যদি পিয়াজই না থাকে তা হলে দাম কমবে কিভাবে?

তিনি বলেন, আমি মন্ত্রী মহোদয়ের সামনেই বলেছি- আমাদের পলিসির ভুল ছিল। আমরা কৃষকদের বীজ দিয়ে সাহয্য করতে পারিনি। ফলে উৎপাদন কম হয়েছে। অন্যদিকে সংরক্ষণ করতে পারিনি। ফলে অনেক পিয়াজ পচে নষ্ট হয়ে গেছে।

মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশে পিয়াজের ঘাটতি ৭ থেকে ৮ লাখ টন। আসলে আমরা ব্যবসায়ীরা দেখছি দেশে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন পিয়াজ ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি ভারত সরকার যখন পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলো। তখন আমাদের দেশে প্রতিদিন পিয়াজের চাহিদা ছিল ৬ থেকে ৭ হাজার টন। সেখানে ১ থেকে দেড় হাজার টন পিয়াজ আমদানি করে চাহিদা মেটানো কিভাবে সম্ভব?
তিনি বলেন, বর্তমানে পিয়াজের খুবই ঘাটতি। মন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন। কিন্তু এই সংকট পরিস্থিতিতে বেশি দাম পাওয়ার আশায় গ্রামীণ কৃষকরা আগাম পিয়াজ তুলছেন। ফলে আগামীতে আবারও পিয়াজের সংকট তৈরি হবে। সভায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন, আমরা ভোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই দেশে লবণ, তেল, চিনি, ডাল এই জাতীয় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়া নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না। এগুলোর দাম আর বাড়বে না। সরকারের পক্ষ থেকে সোজা মেসেজ, কেউ পণ্য মজুত করে অহেতুক দাম বাড়ালেই তাদের শাস্তি দেয়া হবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবে তবে নৈতিকতার দিক খেয়াল রাখতে হবে। বাজারে কোনো জিনিসের ঘাটতি নেই। কিন্তু যদি কেউ অনৈতিকভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পিয়াজের কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, পিয়াজের সব তথ্য নেয়া হচ্ছে। কারা পিয়াজ আমদানি করেছেন, তারা কোথায় বিক্রি করেছেন এসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যারা অস্থিরতার সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কৃষি জাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোন ট্যাক্স নেই। আর আমরা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে আমরা চাল আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছি। প্রয়োজনে এটা আবার কমিয়ে দেয়া হবে।

তিনি বলেন, পিয়াজসহ যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে সেগুলো তথ্য সংগ্রহ চলছে। কোন পণ্য কতটুকু আমদানি হয়েছে সেটা কখন, কিভাবে বিক্রি হয়েছে সেই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে পিয়াজ আমদানির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই কমবে পিয়াজের দাম: বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, আগামী ১০ দিনের মধ্যে আমদানি করা পিয়াজ দেশের বাজারে আসবে। তাছাড়া দেশীয় নতুন পিয়াজ এই সময়ের মধ্যে বাজারে উঠতে পারে। ফলে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পিয়াজের মূল্য স্বাভাবিক হয়ে আসবে। দাম কমার যুক্তি তুলে ধরে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, জাহাজে করে আমদানি করা পিয়াজ দেশের বাজারে আসবে। এ পিয়াজ চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আমদানি খরচ পড়ছে কে?জিপ্রতি ৩২ টাকা। তবে খুচরা বাজারে এটি সর্বোচ্চ ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হবে। এছাড়া ডিসেম্বরের প্রথমেই বাজারে দে?শি নতুন পিয়াজ আসতে শুরু করবে। সবমিলিয়ে বলতে পারি আগামী ১০ দিনের মধ্যে (ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ) পিয়াজের বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

টিপু মুনশি বলেন, বছরে আমাদের ২৪ লাখ টনের মতো পিয়াজ প্রয়োজন। এর মধ্যে এক লাখ টন পিয়াজ আমদানি করতে হয়, যার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই আসে পাশের দেশ ভারত থেকে। কিন্তু ভারত হঠাৎ পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় দেশের বাজারে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় ইতিমধ্যে বড় বড় ব্যবসায়ীদের পিয়াজ আমদানি করতে বলা হয়।

তারা মিশর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পিয়াজ আমদানি কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি, আমদানি পিয়াজ আসতে একমাস সময় লাগবে। তাৎক্ষণিক সংকট মেটাতে উড়োজাহাজে আমদানির সিদ্ধান্ত নিই। বিমানে আমদানি করা পিয়াজের মূল্য অনেক বে?শি পড়বে এরপরও ভোক্তা পর্যায়ে আমরা এই পিয়াজ ৪৫ টাকায় বিক্রি করবো।

বাণিজ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ভারত নিজে পিয়াজ সংকটে ভুগছে তাই বাংলাদেশকে দিতে পারছে না। উড়োজাহাজে করে পিয়াজ আমদানির পরও নাগালের মধ্যে আসছে না বাজার। এজন্য চাহিদা অনুযায়ী আমদানি না হওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
এক প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন,ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিয়েছে।
চালের মূল্য স্বাভাবিক রয়েছে: খাদ্যমন্ত্রী দাবি করে বলেছেন, বর্তমানে দেশে চালের মজুদ রয়েছে। তাছাড়া আমরা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাজারও নিয়ন্ত্রণে। এক কথায় বলতে পারি চালের মূল্য স্বাভাবিক রয়েছে। পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়েনি। তবে কেজিতে দু-এক টাকা দাম বেড়েছে খুচরা বাজারে। তিনি বলেন, মানুষেরর অর্থনৈতিক আয় বাড়ার সঙ্গে খাদ্যপণ্যে পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন মোটা চালের বদলে চিকন চাল খায়। এজন্য চিকন চালের দাম কিছুটা বাড়লেও মোটা চাল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, চিকন চালের দাম বাড়ার পর ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে আমরা এর সমাধান করেছি। এখন চালের বাজার স্বাভাবিক। চালের বাজারে যাতে কোনো কারসাজি না হয় সেজন্য আমাদের ১০টি টিম কাজ করছে।

অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই-এর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর বছরব্যাপী চাহিদা, বাংলাদেশে পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুদ ব্যবস্থা, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনার বিষয়ে বৈঠ?কে আ?লোচনা হয়েছে। আগামীতে নিত্যপণ্যের কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে তা মোকাবিলা করা হবে।

বৈঠকের মূল সিদ্ধান্ত- সরকারি-বেসরকারি পক্ষের অংশগ্রহণে নতুন ইনভেনটরি’ তৈরির এই সিদ্ধান্তকে ‘গতানুগতিক বা সুশীল চিন্তা’ বলে এক সংবাদিক মন্তব্য করলে এর সঙ্গে দ্বিমত করেন এফবিসিসিআই সভাপতি। তিনি বলেন, আমি আপনার সঙ্গে দ্বিমত করছি, এগুলো ব্যবসার খুবই প্রাকটিক্যাল মেথডলজি। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এটা চলমান আছে। এর সঙ্গে বেসরকারি অংশীজনদের যুক্ত করাই আমাদের লক্ষ্য।

শেখ ফাহিম বলেন, মোটা দাগে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, সেটা হচ্ছে একটা সময় বেঁধে দিয়ে কীভাবে একটা সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায়। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কেউ যদি অসাধু ব্যবসায়ী হিসাবে চিহ্নিত হয়, তাহলে এফবিসিসিআই ও বাজার সমিতির মাধ্যমে একটা সঠিক ব্যবস্থা যেন তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়।

পিয়াজের চাহিদা, উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি মো. নুর উর রহমান বলেন, দেশে পিয়াজের চাহিদা আছে ২৪ লাখ টন। রমজানে তা আরো ২ লাখ টন বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে দেশে যে পরিমাণ উৎপাদন হয় তার ২২ থেকে ২৮ শতাংশ, পেঁয়াজ পঁচে যায়। ফলে প্রতিবছর ৯ থেকে ১১ লাখ টন পিয়াজ আমদানি করতে হয়। যার ৯৮ শতাংশ আমদানি হয় ভারত থেকে।