সরকারবিহীন দেশে সর্বত্র অরাজকতা
 
                                বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সহিংসতার রেশ এখনো কাটেনি। বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে। রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে গতকালও পড়ে ছিল লাশ। এই অবস্থায় পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দরকার পুলিশ-প্রশাসনের তৎপরতা। কিন্তু মানুষের জানমালের নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশ-প্রশাসন যেন কোথাও নেই।
বরং নিজেদের নিরাপত্তাসহ ৯ দফার দাবিতে গতকাল কর্মবিরতি শুরু করেছেন নন-ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তারা। ক্যাডার কর্মকর্তারাও কোথাও নেই। আর প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরাও গতকাল অফিস করেননি। ফলে পুলিশ-প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে দেশজুড়ে নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ।
সরকার পতনের পর সংঘর্ষের ঘটনায় রাজধানীতে আরও ৩৫ জন নিহতের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিন শতাধিক। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে ১৫ জেলায় সহিংসতায় আরও ৫০ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদিকে সরকার পতনের এক দিন পরও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কার্যালয়ে হামলা ও লুট অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে মন্ত্রিসভা ও সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় দেশ কীভাবে চলছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তিনি সরকারপ্রধান নন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিই সরকারপ্রধান বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত সোমবার তিন বাহিনীর প্রধানসহ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। আবার আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মঙ্গলবার দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। তবে পুলিশসংশ্লিষ্ট কোনো অফিস বা দপ্তর খোলা পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে গতকাল প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, সকালের দিকে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসে আসেন। কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা এলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন সচিবসহ বেশির ভাগ সচিবকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সচিবালয়ে দেখা যায়নি। ‘নিরাপত্তা নেই, হামলা হতে পারে’ এমন অজুহাতে দুপুর ১২টা নাগাদ সচিবালয় ছাড়েন তাঁদের অনেকে। সচিবালয়ের মূল ফটক দিয়ে গাড়িতে করে ও হেঁটে বের হয়ে যান শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী।
সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অফিসে আগুন লেগেছে, এমন খবর শুনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই সচিবালয় ছাড়তে শুরু করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দু-একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে থাকার আহ্বান জানালেও বেশির ভাগই বেরিয়ে যান।
মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হওয়ায় সচিবালয়ে ছিলেন না কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী। হাতে গোনা দু-তিনজন সচিব সচিবালয়ে গেলেও বেলা ১টার আগেই বেরিয়ে যান। সচিবালয়ের মূল ফটক ছাড়া সব ফটকই বন্ধ ছিল। মূল ফটকে কয়েকজন সেনাসদস্যকে পাহারা দিতে দেখা যায়। মন্ত্রী-সচিবদের কয়েকজন গানম্যানের সচিবালয়ে দেখা মিললেও তাঁরা ছিলেন সাদাপোশাকে। ইতিমধ্যে সচিবালয়ে বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে টাঙানো বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি-ব্যানার নামিয়ে ফেলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন যুগ্ম সচিব আজকের পত্রিকাকে জানান, সচিবালয়ে সাধারণত নিরাপত্তা দেয় পুলিশ। কিন্তু আজ কোনো পুলিশ দায়িত্বে নেই। সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য আছেন, তাও অনেক কম। এ কারণেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সচিবালয়ের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সচিবালয় নিরাপত্তা শাখা) শাহে এলিদ মাইনুল আমিন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সবাই অজানা কারণে চলে যাচ্ছেন। তাঁদের কে ছুটি দিয়েছেন? দলে দলে লোকজন চলে যাচ্ছেন! কেন যাচ্ছেন কিছুই বলতে পারছি না।’
রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম। হাতে একটি পানির বোতল। রবিউলের সঙ্গে আরও ৮-১০ জন শিক্ষার্থী এই চৌরাস্তায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন। শুধু কাকরাইল মোড়েই না, রাজধানীর প্রতিটি রাস্তার মোড়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, পুলিশ হত্যার বিচার, নিরাপত্তা প্রদানসহ ৯ দফার দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেছেন নন-ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তারা। আর পুলিশ অধিদপ্তরসহ পুলিশ প্রশাসনের ক্যাডার কর্মকর্তারাও হঠাৎ উধাও হয়েছেন। ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের কেপিআইভুক্ত সরকারি স্থাপনাসমূহ।
হামলা-আগুনের পর রাজধানীর বেশির ভাগ থানায় গতকাল ছিলেন না কোনো পুলিশ সদস্য। ঢাকার বাইরে অনেক জেলা থেকে খবর পাওয়া যায়, থানায় কোনো পুলিশ সদস্য নেই। অরক্ষিত পড়ে আছে থানা।
থানায় থানায় যখন এই অবস্থা, তখন দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, অভ্যর্থনা কক্ষে কোনো লোকজন নেই। প্রধান ফটকের ভেতর পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দুজন নিরাপত্তাকর্মী ফটক পাহারা দিচ্ছেন। ভেতরে দেখা গেছে আট-নয়জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী বসে রয়েছেন। আইজিপির অফিস ভবনের বেশ কিছু জানালার কাচ ভাঙা।
আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে অফিস করেননি অধিকাংশ কর্মকর্তা। ছিলেন না প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। দেশের প্রায় সোয়া ১২ কোটি ভোটারের তথ্যসংবলিত সার্ভারস্টেশন রয়েছে নির্বাচন ভবনে। জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকা এই ভবনে ছিল না কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা। এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তর, এলজিইডি ভবন, বন অধিদপ্তরের মূল ফটক বন্ধ দেখা যায়। শুধু পাসপোর্ট ও বহির্গমন অধিদপ্তরের সামনে আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।

 
                 
                                                    -2019-06-05-12-27-15.jpg) 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                        -2024-09-02-09-55-40.jpg) 
                                                         
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                            