পিএসসির প্রশ্নফাঁস: চক্রের ‘গুরু’ আবেদকে প্রশ্ন দিতেন সাজেদুল
 
                                তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এক যুগ ধরে চক্রটি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে আসছে। এর সঙ্গে বিজি প্রেসকেন্দ্রিক একটি দল জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রশ্ন হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে দেয়া হতো না; বরং পরীক্ষার আগের রাতে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের নেয়া হতো গোপন আস্তানায়। ৫ জুলাই রেলের নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতেও ঢাকার চারটি স্থানে প্রায় ২০০ পরীক্ষার্থীকে নেয়া হয়। সেখানে তাদের প্রশ্ন ও উত্তর দেয়া হয়। পরীক্ষার্থীরা সেগুলো মুখস্থ করে সেখান থেকে বের হন। পল্টনে ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন ও তার ভাই সায়েম হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ৪৬ পরীক্ষার্থীকে প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করানো হয়। প্রশ্ন ফাঁসের কোনো প্রমাণ না রাখতেই এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
পিএসসি থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন গ্রেফতার কয়েকজন। রেলের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন কয়েক মাস আগে মডারেশন পর্যায়ে (চূড়ান্ত নির্বাচন) ফাঁস হয়। গ্রেফতারদের ভাষ্যমতে, উপপরিচালক আবু জাফরের মাধ্যমে প্রশ্ন পান সাজেদুল। তবে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে দুই রকম বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ধারণা, জাফরকে রক্ষার চেষ্টা করছেন সাজেদুল। পিএসসির প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত অভিযোগে রোববার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের মধ্যে রয়েছেন পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর, উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের রাজনীতি করা ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মী মামুনুর রশীদ, ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন ও তার ভাই সায়েম হোসেন, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র লিটন সরকার, নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তাকর্মী শাহাদাত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের টেকনিশিয়ান নিয়ামুন হাসান ও আবেদ আলীর ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।
পাঁচজন সাময়িক বরখাস্ত
এ ঘটনায় গতকাল পিএসসির সহকারী পরিচালক আলমগীর কবিরসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অপর চারজন হলেন উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম।
সিআইডির মামলা
গ্রেফতার ১৭ জনসহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে গতকাল রাজধানীর পল্টন থানায় সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা করে সিআইডি। পলাতক আসামিরা হলেন– পিএসসির সাবেক পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বণিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এ টি এম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, মো. আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ। এ মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে আরও ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের এক প্রতিবেদনে পিএসসির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত হিসেবে এই চক্রের কথা বলা হয়।
ছয়জনের স্বীকারোক্তি
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) আজাদ রহমান জানান, গ্রেফতার ১৭ জনকে গতকাল আদালতে হাজির করা হলে ছয়জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা হলেন– সৈয়দ আবেদ আলী, সাজেদুল ইসলাম, খলিলুর রহমান, সায়েম হোসেন, লিটন সরকার ও সাখাওয়াত হোসেন। পরে ১৭ জনকেই কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
৫০ লাখ টাকায় বিসিএস পাসের প্যাকেজ
গ্রেফতার ১৭ জন দুটি গ্রুপে কাজ করতেন। চুক্তি অনুযায়ী একজন প্রার্থীর কাছে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে তারা এক থেকে দুই লাখ টাকা নিতেন। একইভাবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার আগে এক থেকে দুই লাখ টাকা দিতে হতো। নিয়োগ চূড়ান্ত হয়ে গেলে দিতে হতো বাকি টাকা। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা নিতেন তারা। আর বিসিএসের জন্য চুক্তি হতো ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকায়।
এজাহারে যা রয়েছে
গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ৭ জুলাই ঢাকার শ্যামলী থেকে লিটন সরকারকে আটক করে সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রিয়নাথ ও জাহিদের কাছ থেকে তিনি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নেন। এ জন্য চুক্তি অনুযায়ী তাদের টাকা দিয়েছেন। তার তথ্যের ভিত্তিতে মহাখালী থেকে প্রিয়নাথকে আটক করা হয়। জাহিদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পান তিনি। পরে শ্যামলী থেকে জাহিদকে আটক করা হয়। জাহিদ জানান, রংপুরের সুমনের মাধ্যমে তিনি প্রশ্ন সংগ্রহ করেন। পরে তাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, নোমান সিদ্দিকী প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সক্রিয় সদস্য। মিরপুর থেকে গ্রেফতারের পর তিনি তার সম্পৃক্ততা স্বীকার করেন।
জাহাঙ্গীর এই চক্রের আরেক সক্রিয় সদস্য। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। চক্রের সদস্য শাহাদাত হোসেন, মামুন ও নিয়ামুলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য হলেন খলিল। তিনি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে ফাঁস করে আসছেন। খলিল জানান, প্রার্থী সরবরাহ করতেন পিএসসির সহকারী পরিচালক আলমগীর। এ ছাড়া চক্রের অন্যতম হোতা সাজেদুল ইসলামের সহযোগী সাখাওয়াত ও সায়েম দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন। সাজেদুলের তথ্যে সৈয়দ আবেদ আলী, তার ছেলে সোহানুর রহমান সিয়াম, সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেনকে আটক করা হয়। আবেদ আলী জানান, সোহেল রেলের নিয়োগ পরীক্ষার আগে প্রার্থী সরবরাহ করেন।
প্রশ্নফাঁসের অপকর্মে বারবার
পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্তত তিনজন প্রশ্ন ফাঁসের অপরাধে অতীতে শাস্তি পান। এর পরও তাদের অপকর্ম থামেনি। চক্রের হোতা আবেদ আলী ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ ডিসেম্বর পিএসসিতে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদে লিখিত পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। সেই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুত হন তিনি।
আবেদ আলীর যোগদানপত্রে ভুয়া ঠিকানা
আবেদ আলী চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময়ও প্রতারণার আশ্রয় নেন। স্থায়ী ঠিকানা গোপন করে ভিন্ন ঠিকানা দেন। স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন– সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের শ্রীফলতলা গ্রাম। তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে এই প্রতারণা ধরা পড়ে। বিভাগীয় মামলার অভিযোগনামা স্থায়ী ঠিকানায় পাঠালে তা ফেরত আসে। সাময়িক বরখাস্তের আদেশও ফেরত আসে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে পিএসসিকে জানানো হয়, আবেদ আলীর দেয়া ঠিকানা সঠিক নয়। এ নামে কেউ সিরাজগঞ্জে নেই। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি বিভাগীয় মামলা হয়।
আবেদ আলী ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকরিতে যোগ দিলেও ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালকের দায়িত্ব পান। সে সময় পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী। এর পর ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও সাবেক ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ইকরাম আহমেদ। তিনি ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত চেয়ারম্যান ছিলেন। তার সময়েই চাকরি থেকে বরখাস্ত হন আবেদ আলী।
বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ। তবে বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘আবেদ আলীর ব্যাপারে বলতে পারব না। তিনি অপকর্মে জড়ানোয় অনেক আগেই বরখাস্ত হয়েছেন। কার মেয়াদে আবেদ আলী চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন, সেটাও আমার জানা নেই।’
পিএসসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আগে এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, আবার অনেকে ফিরে এসেছেন। যারা ফিরেছেন, তাদের অনেকে আদালতের আদেশে ফিরেছেন; আবার অনেকে অন্যভাবে ফিরেছেন। আমরা সব সময় প্রস্তুত সরকারের বিধান বাস্তবায়নে।’
দুই কর্মকর্তার কোচিং ব্যবসা
প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে পিএসসির উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকদের কয়েকজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে প্রথমে পিএসসিতে যোগ দেন। পদোন্নতি পেয়ে উচ্চতর পদে যান তারা। তাদের মধ্যে উপপরিচালক আবু জাফর ও সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির চাকরির প্রস্তুতির কোচিং ব্যবসায় যুক্ত। বিষয়টি পিএসসির অনেকেই জানেন। ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় জ্যোতি কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটের পরিচালক আবু জাফর। তার স্ত্রী জ্যোতি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। আবু জাফর ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে পিএসসিতে যোগ দেন।
অন্যদিকে, আলমগীর কবিরের কোচিং সেন্টার আছে ঢাকার মিরপুরে।
আদালতের রায়ে পিএসসিতে ফেরেন খলিলুর
পিএসসির কর্মচারী খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ফৌজদারি ও বিভাগীয় মামলা হলেও আদালতের রায় নিয়ে তিনি আবার প্রতিষ্ঠানটিতে ফেরেন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ৩৩তম বিসিএসের সময় খলিলুরের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়। তখন তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সময় তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে মামলা ও বিভাগীয় মামলায় যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়।
আবেদ আলী পরিবারের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ
সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর পরিবারের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আগামী ৩০ দিন তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
গতকাল এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে তাদের হিসাব থেকে লেনদেনসহ যাবতীয় তথ্য আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়, সৈয়দ আবেদ আলী, তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সোহান, স্ত্রী শাহরিন আক্তার শিল্পী এবং আবেদের মালিকানাধীন ঊষা রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্সের হিসাব আগামী ৩০ দিনের জন্য জব্দের নির্দেশনা দেওয়া হলো।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 
                 
                                                    -2019-06-05-12-27-15.jpg) 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                        -2024-09-02-09-55-40.jpg) 
                                                         
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                            