চুরির রপ্তানি পন্য কিনছে মালিকরাই !

রপ্তানির গার্মেন্টস পণ্য চুরির ভয়াবহ সিন্ডিকেটের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বর্হিবিশে^ দেশের গার্মেন্টস শিল্পের অর্ডার বাতিলসহ ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে সরকার বিরোধী একটি চক্র এ কাজ করে যাচ্ছে। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের চালকদের একটি চক্র এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। ঢাকা -চট্রগ্রাম মহাসড়কের যে স্থানেই পণ্য চুরি হোক এর মূল আস্তানা হলো তেজগাঁও। পণ্য চুরির পর তা আবার গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের নিকট তারা বিক্রিও করে। অর্থাৎ যে গার্মেন্টেসের পণ্য বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল সেটিই তাদের চোরদের নিকট থেকে পূণরায় কিনতে হচ্ছে টাকা দিয়ে।
এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা এ সিন্ডিকেটের অন্তত অর্ধশত চালক ও সদস্যদের নজরদারীর মধ্যে রেখেছেন বলেও জানা গেছে। যে কোন মুহুর্তে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি এভার ফ্যাশন টঙ্গি লিমিটেডের ৭২ লাখ টাকার রপ্তানি গার্মেন্টস পণ্য চুরি হয়। চুরি হওয়ার পর চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা ফোন দেন এভার ফ্যাশনের কর্মকর্তাদের। পণ্য ফেরতের জন্য দফায় দফায় হয় আলোচনা। এক পর্যায়ে প্রায় ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে তারা পণ্যগুলো ফেরত পায়। টেকনো ফাইবার লিমিটেডের ৫১ লাখ টাকার মালামাল চুরি হয়। একই কায়দায় ২ লাখ টাকার বিনিময়ে ফেরত আনা হয় তাদের সেই চুরি পণ্য। প্রোটেক্স গার্মেন্টসের ১০ লাখ টাকার পণ্য চুরি হয়। ১ লাখ টাকার চুক্তিতে তারাও ফেরত পান। জায়ান্ট টেক্সটাইলের প্রায় কোটি টাকার পণ্য চুরি হলেও তারা সমঝোতার মাধ্যমে ফেরত আনে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্রগ্রাম ডেপো থেকে শুরু করে রাস্তার মাঝখানে যেখানেই তারা পণ্য চুরি করে। এরপর তারা ট্রান্সপোর্টের মালিক ও পণ্যের ইনভয়েসে থাকা গার্মেন্টস পণ্যের মালিকসহ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা সমঝোতার মাধ্যমে চুরি হওয়া পণ্য ফেরত দেয়। এক্ষেত্রে মালিকরা আইনের আশ্রয়ে যান না। কিংবা চুরির পর মালিকরা মামলা করেন না। মামলা করতে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির কর্মকর্তাদের।
জানা যায়, কত টাকার পণ্য চুরি হলো সেই মূল্যের ভিত্তিতে ফেরতের জন্য দরকষাকষি হয়। এক্ষেত্রে ২ লাখ ১০ লাখ টাকার মধ্যে সমঝোতা হয়ে যায়। সমঝোতা হওয়ার কারণে অনেক সময় পণ্য চুরি হয়েছে কি না সেটা থানা পুলিশের তথ্যের মধ্যেও থাকেনা। যারা কেবল থানায় এসে মামলা করেন সেটাই নথিভুক্ত থাকে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এ চক্রটির অন্যতম নেতা হলেন তালুকদার মনির। তিনি ট্রাক কাভার্ডভ্যান চালক ইউনিয়নের সভাপতিও। এছাড়াও সিন্ডিকেটের অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছে সহ-সভাপতি জলিল ও আইন সম্পাদক সুরুজ। এদের নেতৃত্বে কমপক্ষে শতাধিক সদস্য রয়েছে তাদের। যারা বিএনপি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। মূলত বর্হিবিশে^ দেশের সুনাম ক্ষুন্ন ও রপ্তানিমুলী এ শিল্পকে বেকায়দায় ফেলতে এ রকম নানা ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত। দেশের ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে কোন গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ মালামাল নিয়ে চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা রাস্তার মধ্যেই কৌশলে তা চুরি করে। চুরি করা প্যাকেটের মধ্যে ওজন ঠিক রাখতে ঝুট, ভুসি এমনকি ইটপাথরও রাখা হয়। ডেপোতে সিএন্ডএফ এজেন্ট যদি পূর্নাঙ্গভাবে চেক না করে তবে তা ওইভাবেই চলে যায় দেশের বাইরে। পরে বায়াররা কোম্পানিকে ফোন করলে তারা জানতে পারে তাদের মালামাল চুরি হয়েছে। এরপর তারা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিকে জানায় তাদের পণ্য চুরি হয়েছে। আবার চুরির পর চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের নেতাদের জানানোর পর তারাই কোম্পানি বা ট্রান্সপোর্টের মালিককে জানিয়ে দেয় তাদের পন্য চুরি হয়েছে। পণ্য ফেরত পেতে তখন দরকষাকষি হয়। একপর্যায়ে সমঝোতা করে সেই পণ্যগুলো ফেরত নেয় কর্তৃপক্ষ। আর এর মাধ্যমেই মনির কোটি কোটি টাকার মালিক হেয়ছেন বলেও জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভারের আশুলিয়ার জয়ন্তী নিটওয়্যার লিমিটেডের পণ্যবোঝাই কাভার্ড ভ্যান চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়। সেই পণ্য ইংল্যান্ডে ক্রেতার হাতে পৌঁছনোর পর দেখা যায়, সেখানে ১১ হাজার পিস কম। এ ঘটনায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করে জয়ন্তী কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের নেটওয়ার্ক ক্লোদিং লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের পাঁচ হাজার পিস কাপড় চুরি হয়। তাদের তৈরি শিশুদের পোশাক চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে জার্মানি যাচ্ছিল। পরে এই প্রতিষ্ঠানও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করে। কয়েক মাসের মধ্যে ঘটেছে এ দুটি ঘটনা।
জানা যায়, সম্প্রতি এ রকম আরো অন্তত ৪০টি ঘটনা ঘটেছে। এভাবে কোটি কোটি টাকার গার্মেন্ট পণ্য চুরি হয়েছে। সংঘবদ্ধ চোরচক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একের পর এক এ রকম ঘটনা ঘটাচ্ছে। ফেরত আনতে দিতে হচ্ছে টাকাও। এতে উদ্বিগ্ন পোশাক রপ্তানিকারকরা। এতে গার্মেন্ট কারখানা মালিকদের জরিমানা গোনার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে দেশের সুনাম। এ অবস্থায় চুরি ঠেকাতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানা থেকে পণ্য বোঝাই করে ট্রাক অথবা কাভার্ড ভ্যান যখন শিপমেন্টের উদ্দেশ্যে বন্দরের দিকে যায় তখন রাস্তার মধ্যে চোরচক্র কৌশলে কাভার্ড ভ্যান থেকে তা চুরি করে। চক্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে কোটি কোটি টাকার পণ্য চুরি করলেও তাদের বেশির ভাগ সদস্য গ্রেপ্তার হচ্ছে না। এতে বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প ক্রেতাবিমুখ হয়ে পড়ছে। বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশি শিল্প।
সম্প্রতি এ ধরনের একাধিক ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে নিট পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন (বিকেএমইএ) এবং ক্রেতাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুকারক ও রপ্তানিকারক সমিতিকে (বিজিএমইএ) চিঠি দিয়েছে অনেক ক্রেতা।
বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘রপ্তানিমুখী পোশাক বন্দরে পৌঁছার আগে রাস্তায় চুরি এবং হারানো যাচ্ছিল। এর ফলে বিদেশে ক্রেতাদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে। অনেক বিদেশি ক্রেতা পরবর্তী কার্যাদেশও বাতিল করে। এসব সংকট নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পর চুরি কিছুটা কমে এসেছে। সম্প্রতি পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে এ নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে ২৩ দফা একটি সুপারিশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে, এটা অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে আমলে নিয়ে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা।’
এসংক্রান্ত কমিটির সদস্যসচিব, পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) মোশারফ হোসেন মিয়াজী বলেন, ‘শিগগিরই চুরি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে।’
চুরির বিষয়ে গার্মেন্ট কারখানার মালিকদেরও কিছু অবহেলা রয়েছে জানিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, কোটি কোটি টাকার পণ্য পাঠানোর সময় পরিবহনের সঙ্গে নিজেদের কোনো লোক রাখছে না মালিকপক্ষ। বরাবরই কর্তৃপক্ষ চালকের ওপর ভরসা করে পণ্য বন্দরে পাঠানোর ঝুঁকি নিচ্ছে।
ট্রাক-প্রাইমমুভার পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহম্মদ বলেন, গার্মেন্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে বসে আমরা যৌথভাবে একটি নীতিমালা করছি। এটি বাস্তবায়িত হলে চুরি ঠেকানো যাবে।
তিনি বলেন, বহুমুখি সংকট রয়েছে। আমরা কাটিয়ে উাার চেষ্টা করছি।
পরিস্থিতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ।
তিনি বলেন, আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা চুরি রোধ ঠেকাতে কাজ করছি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি আমরা গার্মেন্টস চুরি চক্রের কয়েকটি সিন্ডিকেটকে গ্রেফতার করেছি। আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি দ্রুত এ সিন্ডিকেটকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
গার্মেন্টস, ডিবি পুলিশ