ঢাকা সোমবার, ৫ই মে ২০২৫, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩২

সন্ত্রাসী জঙ্গিদের হাতে চোরাই মোবাইল


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:৩৫

প্রতিকি

আমদানী করা চোরাই মোবাই সেট এখন সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের হাতে। মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে এ ধরনের মোবাইল সেট ব্যবহার করেছে তারা। চোরাই পথে আনা মোবাইলসেটগুলো ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি অর্থাৎ আইএমইআই নম্বর থাকেনা আবার দেখা যাচ্ছে একই আইএমইআই নম্বর শত শত মোবাইল সেটে থাকছে যার কারণে দাগী অপরাধী সনাক্তে বিপাকে পড়তে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে অধরাই থেকে যাচ্ছে দাগী সন্ত্রাসীরা। সম্প্রুতি আইএমই নম্বর পাল্টে দেয়া চক্রকে গ্রেফতারও করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। তাদের নিকট থেকেও পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে এক শ্রেণীর চক্র বিশেষ করে চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বিভিন্ন ব্রান্ডের মোবাইল সেট পাচার করছে। পরে সেগুলো রাজধানী অভিযাত মার্কেট থেকে শুরু দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এই সেটগুলোকে নিজেকে লুকিয়ে ও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকতে সন্ত্রাসী দাগি আসামিরা ব্যবহার করছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমস, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব ও বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশনন বিটিআরসি যৌথ অভিযান চালিয়ে গত কয়েকমাসে এ ধরনের কয়েক হাজার মোবাইল সেট উদ্ধার করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কুরিয়ার ব্যবহার করে সম্প্রতি চীন থেকে আনা প্রায় ২২ হাজার মোবাইল সেট জব্দ করে কাস্টমস। তারা কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেন এই বিপুল পরিমান মোবাইল সেট আমদানীর ক্ষেত্রে বিটিআরসির কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। পাশাপাশি মোবাইল গুলোর কোন আইএমইআই (আইএমই) নম্বরও নেই। এছাড়াও যে গুলোর আইএমই নম্বর আছে একই আইএমই নম্বরের আরো অনেক সেট রয়েছে।

সূত্র জানায়, মোবাইলের যন্ত্রাংশ ঘোষণা দিয়ে আনা এই সেটগুলোর যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে তাও ভূয়া। পরবর্তী গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করলে এর প্রমান পায়। দেখা যায় চোরাই পথে আনা মোবাইল সেটগুলোর আইএমই নম্বর থাকেনা। আবার যেগুলোর থাকে সেগুলোর একই নম্বরে অনেক মোবাইল সেট থাকে। অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থা বুঝতে বাকি থাকেনা এগুলো সাধারণত অপরাধমূলত কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করার জন্য সেটগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহকরাও এই মোবাইলগুলো কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে জানা যায়, সম্প্রতি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দাগী আসামি গ্রেফতারে প্রযুক্তির সহায়তা অপারেশন শুরু করে। এক পর্যায়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তথ্য বিভ্রাটের মধ্যে পড়ে যায়। পরে বিটিআরসির সহযোগীতা চাইলেও তারা এক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। পরে পুলিশ বিটিআরসির বিরুদ্ধে সহযোগীতা না করার অভিযোগও তোলে। এরপরই বিটিআরটির কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। বিটিআরসি তদন্ত করে দেখে একই আইএমই নম্বরের মোবাইল সেট শত শত। আবার দেখা যাচ্ছে কোন মোবাইল সেটের আইএমই নম্বর-ই নাই। পরে বিটিআরসি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সহযোগীতা নিয়ে দেশব্যাপি অভিযানে নামে। সম্প্রতি রাজধানীর বসুন্ধারা সিটিতে অভিযান চালিয়ে এ ধরনের কয়েক হাজার মোবাইল সেট জব্দ করে।

আইরন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, একজন অপরাধী কখনই তার নিজের পরিচয়পত্র দিয়ে মোবাইলের সিম কেনে না। পাশাপাশি সে যে মোবাইল সেট ব্যবহার করে তার উপর ভিত্তি করে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এ অবস্থার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতিনিয়ত সমস্যার সন্মুখিন হতে হচ্ছে। অবশ্য এ ধরনের সেট ব্যবহার করছে প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন অপরাধীরা। বর্তমানে জঙ্গি সংগঠণের সঙ্গে সম্পৃক্ত অধিকাংশই তরুণ এবং যুবক। যারা প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন। মূলত এদের মোবাইল নম্বর ও মোবাইল সেট কোনটির-ই সঠিক তথ্য থাকছেনা। বিষয়টি অনুধাবন করেই এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে।

রুট শাহজালাল : গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য মতে চোরাই মোবাইলের রুট হচ্ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এক শ্রেণীর চক্র কতিপয় সিএন্ডএফ এজেন্ট দিয়ে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে তারা এ সকল মোবাইল আমদানী করে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সূত্র জানায়, আইএমইএ না থাকা ও একাধিক আইএমইআই নম্বরের মোবাইল সেট গুলোর মধ্যে রয়েছে স্যামসাং, সনি, সনি এক্সপেরিয়া, প্রভূতি। সূত্র মতে, এই সেট আমদানীতে কোম্পানির কিছু অসাধূ কর্মকর্তারাও জড়িত।

ঢাকা কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা মাহবুব হাসান বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা খবর পাই মোবাইলের যন্ত্রাংশ ঘোষণা দিয়ে মোবাইল আমদানী করে তা খালাসের চেষ্টা করছে একটি চক্র। পরবর্তীতে আমরা তল্লাশি চালিয়ে সেটি জব্দ করি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শাহজালাল বন্দরের কুরিয়ার বা ফ্রেইট দিয়ে এসব মোবাইলের চালান বের হওয়া সম্ভব নয়। বিমানবন্দর ব্যবহার করে লাগেজ সুবিধা নিয়ে কেউ করতেও পারে। তবে আমরা সবসময় সতর্ক থাকি যেন চোরাচালান পণ্য কোনভাবেই বের হতে না পারে। পাশাপাশি শুল্ক ফাঁকি যেন কোন পণ্য বের হয়ে না যায়।

বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ সেটের আইএমইআই ঠিক থাকে না। দেখা যায় একাধিক সেটে একই আইএএমআই নম্বর। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধে এসব মোবাইল সেট ব্যবহার হয়। যার কারণে আমরা এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।

কাউন্টার টেরোরিজমের পুলিশ সুপার ছানোয়ার হোসেন বলেন, একই নম্বরের আইএমই যখন একাধিক হয় তখন সেটাকে ক্লোন বলে। আর এই ক্লোন সেট বিশেষ করে প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন অপরাধীরা ব্যবহার করছে। আইএমইএ নম্বর না থাকা ও একাধিক আইএমইএ কারণে অপরাধী সনাক্ত ও গ্রেফতারে সমস্যা হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। পাশাপাশি আইএমইআই নম্বর না থাকা ও একাধিক আইএমইআই নম্বরের ব্যক্তিকে আমরা গ্রেফতারও করেছি।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেঃ কর্ণেল আশিক বিল্লাহ বলেন, বিটিআরসির সহযোগীতায় আমরা এ ধরনের সেটের বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করেছি। মূলত অপরাধীরা তাদের নিজেকে লুকিয়ে রাকতে এ ধরনের সেট ব্যবহার করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আইএমইআই পাল্টে দেয়া চক্র গ্রেফতার : এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চুরি বা ছিনতাই হওয়া মোবাইলগুলো তাদের কাছে আসতো। পরে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে সেসব মোবাইলফোনের আইএমইআই নম্বর বদলে বিক্রি করতো চক্রটি।

র‌্যাব বলছে, আইএমইআই নম্বর বদলানো হলে চোরাই মোবাইল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। গ্রেফতারকৃতরা রাজধানীর চোরাই মোবাইল সংগ্রহ করে এ কাজটি করতো।

পল্টন ও তেজগাঁও এলাকায় গত বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র‌্যাব জানায়, ওরা একটি বিশেষ সফটওয়ারের মাধ্যমে চোরাই মোবাইলের ওগঊও নম্বর বদলে দিত। ওই মোবাইল দিয়ে পরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় আরও কয়েকজনের বিষয়ে খতিয়ে দেখছে র‌্যাব।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন শফিকুল ইসলাম (২৫), মাসুদ আহমেদ রানা (৩২), মো. ইমন (২৩), সিরাজ আলি (৩০), রানা হাজরা (২৬) ও আলামিন (১৯)। তাদের কাছ থেকে একটি কম্পিউটার, সাতটি মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের সফটওয়্যার, ২০টি মোবাইল ও নগদ ৬৬,৮৫০ টাকা উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব ১০-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান বলেন, মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করাটাই বড় অপরাধ। যে সফটওয়্যার তারা ব্যবহার করতো তা কিন্তু চাইলেই ডাউনলোড করা যায় না। সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাও এর সঙ্গে জড়িত। যারা বাংলাদেশ এ কাজ করছে তারা প্রত্যেকেই অপতৎপরতায় লিপ্ত। পুরো কার্যক্রমটি অবৈধ।

মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, গ্রেফতারকৃতরা নিজেরাই ওই অ্যাপের মাধ্যমে চোরাই মোবাইলের ওআইএমইআই নম্বর বদলাতো। এ চক্রের মধ্যে কয়েকজন ব্যবসায়ীও রয়েছে, যারা ওই সফটওয়্যার ও অ্যাপস সরবরাহ করতো। তাদের বিষয়েও র‌্যাব নজরদারী বাড়িয়েছে। তাদেরকে গ্রেফতারেও অভিযান চালানো হবে।