নিরাপত্তার হুমকি উজির ১১১ পিস্তল নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ কর্মকর্তারা
-2020-11-15-02-03-05.jpg)
ইসরাইলের তৈরী উজি পিস্তল নিয়ে উদ্বেগ কাটছেনা পুলিশের। হুমকি এ সকল পিস্তল বেসামরিক লোকদের নিকট থেকে হস্তান্তরের এখন পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাননি কর্মকর্তারা।
উদ্বেগের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে সেগুলো হেফাজতে নেয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে এখনো সেই বিষয়ে কোন নির্দেশনা আসেনি। কর্মকর্তারা বলছেন, বেসামরিক লোকদের নিকট থাকা এ অস্ত্র খুবই হুমকি স্বরুপ। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেগুলো নিয়ন্ত্রনে নিতে চায়। তবে এখনো নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে সামরিক ও পুলিশ বাহিনীতে ব্যবহৃত উজি পিস্তল ‘বৈধভাবে’ আমদানি হয়ে দেশের বেসামরিক নাগরিকদের হাতে পৌঁছে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন পুলিশ কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, ‘মিলিটারি গ্রেডের’ সেমি অটোমেটিক এই আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের হাতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
গত ২০ অগাস্ট এক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তারের পর তার লাইসেন্স করা অস্ত্রটি বিস্ময় হয়ে আসে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে।
নামে পিস্তল হলেও উজি পিস্তল আসলে অতি ক্ষুদ্র আকারের সাব মেশিনগান। আর বাংলাদেশে সেগুলো আমদানি করা হয়েছে পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলের ঘোষণা দিয়ে।
ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর মেজর উজিয়েল গালের করা নকশায় চল্লিশের দশকে প্রথম এ অস্ত্র তৈরি হয়। তার নামেই এ সাব মেশিনগানের নামকরণ হয়।
শুরুতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার করলেও পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি লাইসেন্স নিয়ে উজি সিরিজের বিভিন্ন আগ্নোয়াস্ত্র তৈরি শুরু করে। বাংলাদেশে পাওয়া অস্ত্রটি তৈরি করেছে বিখ্যাত জার্মান অস্ত্র নির্মাতা কার্ল ওয়ালথার।
এরইমধ্যে প্রায় অর্ধশত ‘উজি পিস্তল’ বেসামরিক নাগরিকদের হাতে চলে গেছে। সেগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকরে বলেন, “উজি পিস্তল সাধারণ মানুষের কাছে থাকাটা বড়ই উদ্বেগের। আমরা এসব অস্ত্রের বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। সেখান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাবে। তবে এখনও কোনো দিক থেকে নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।”
উদ্বেগের জেনেও এসব অস্ত্র জব্দের পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “এসব অস্ত্র যেহেতু বৈধভাবে আমদানি করা হয়েছে এবং যারা কিনেছেন তারা লাইসেন্সের মাধ্যমে কিনেছেন সেগুলোর ব্যাপারে এই মুহূর্তে পুলিশের করণীয় কিছু নেই। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হবে।”
তবে লাইসেন্সধারী যে সব ব্যক্তি এসব অস্ত্র কিনেছেন, তাদের বিষয়ে ইতোমধ্যে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
জানা গেছে, ছয়টি প্রতিষ্ঠান গত পাঁচ বছরে এ ধরনের মোট ১১১টি আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি করেছে। সবগুলোই আনা হয়েছে পয়েন্ট টু টু বোরের ‘রাইফেল’ ঘোষণা দিয়ে। যদিও কোনো মডেলের উজি তাদের আমদানি বা বিক্রি করতে পারার কথা নয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই ১১১টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ৯১টি উজি পিস্তল এবং ২০টি উজির অন্য মডেলের অস্ত্র। উজি পিস্তল বিক্রি হয়েছে ৪৯টি, বাকি মডেলের চারটি।
২০ অগাস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে মিনাল শরীফ (৫৬) নামে একজনকে গ্রেপ্তারের পর তার গাড়িতে একটি অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়া যায়। পরে তার ধানমণ্ডির বাসায় অভিযান চালিয়ে ৪৪টি গুলিসহ একটি ‘উজি পিস্তল’ এবং বিদেশি মদ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই ধরনের অস্ত্র প্রথম কোনো বেসামরিক ব্যক্তির কাছে দেখেন তারা। অস্ত্রের ধরন দেখে সন্দেহ হওয়ায় মতামত নিতে সেটি ঢাকা সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়। পরে এটি মিলিটারি গ্রেডের অস্ত্র বলে গোয়েন্দা পুলিশকে জানায় সেনাবাহিনী।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, সেনানিবাসের মতামত পাওয়ার পর বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেন তারা। আগ্নেয়াস্ত্রটির বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন।
সেনাবাহিনীর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ত্রের লাইসেন্সে পয়েন্ট টু টু বোর লেখা থাকলেও সেমিঅটোমেটিক উজি পিস্তল কেনা যাবে না। এর এক ম্যাগাজিনে ২০ রাউন্ড গুলি থাকে, যেখানে সাধারণ পিস্তলে থাকে ১৫ রাউন্ড।
ওই প্রতিবেদন দেওয়ার পরে প্রায় দুই মাস হতে চললেও এখনও কোনো নির্দেশনা পাননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা।
পুলিশ উদ্বেগের কথা বললেও এসব অস্ত্র আনার ক্ষেত্রে ‘অবৈধ কিছু করা হয়নি’ বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ আর্মস ডিলার অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাসির আহমেদ।
তিনি বলেন, “এটা নিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। অস্ত্রের গায়ে উজি পিস্তল লেখা থাকলেও সেটা একটা মডেলের নাম। আসলে এটি পয়েন্ট টু টু বোরের অস্ত্র। আর কোনো পিস্তলের গায়েই পিস্তল কথাটি লেখা থাকে না।”
এই অস্ত্র অন্য ‘সব বৈধ অস্ত্রের মতই’ দাবি করে অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম লিটন বলেন, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কাস্টমসসহ বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে অনুমোদন পান। তারপর অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে অর্ডার দেন।
“আমাদের অর্ডার পাওয়ার পর তারা অস্ত্র তৈরি করে সরবরাহ করে থাকে। এতে করে প্রায় ১০-১১ মাস লেগে যায়। এরপর দেশে আসার পর বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে আমদানিকারকদের কাছে আসে।”
উজির মত অস্ত্র আমদানি ও বিক্রির অনুমোদন কীভাবে দেওয়া হল, অনুমোদন ও আমদানির কোনো পর্যায়ে অসঙ্গতি ধরা পড়ল না কেন- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (আইন ও শৃঙ্খলা) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।
তবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, উদ্ধার করা লোইসেন্সে শুধু ‘পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেল’ কথাটি লেখা ছিল। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ক্যালিবারে কথা লেখা থাকলেও অস্ত্রের ধরন, ম্যাগাজিন ক্যাপাসিটি, স্পেসিফিকেশন, অ্যাকশন টাইপ, ম্যাক্সিমাম ইফেক্টিভ রেঞ্জ উল্লেখ করার কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।
“আমাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ত্রের লাইসেন্সে ক্যালিবার ছাড়াও অস্ত্রের ধরন ও অন্যান্য তথ্য সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। সেনাবাহিনী যে মতামত দিয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের হাতে এ ধরনের অস্ত্র থাকলে তাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে।”
শফিকুল ইসলাম লিটন বলেন, ৫৩টি অস্ত্র বিক্রি করার পর তাদের কাছে এখন ৫৮টি অস্ত্র আছে। ব্যাপক আলোচনা শুরু হওয়ায় তারা সেগুলোর বিক্রি বন্ধ রেখেছেন।
আর উপ-কমিশনার রাসেল বলেন, যেসব উজি পিস্তল এখনও অবিক্রিত রয়েছে সেগুলোর বিক্রি বন্ধ রাখতে তারা সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেছেন।
“৫৩টি যাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে, তাদের নামের একটি তালিকা আমদানিকারকদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে।”
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, কারা এসব অস্ত্র কিনেছেন তাদের পরিচিতি-অবস্থান জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে তাদের অস্ত্র জব্দ করার বা সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো নির্দেশনা দেয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব অস্ত্রের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিবেদন পুলিশ কমিশনারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।