ঢাকা রবিবার, ২২শে জুন ২০২৫, ৮ই আষাঢ় ১৪৩২


নয়াপল্টনে হচ্ছেনা বিএনপির সমাবেশ


৭ ডিসেম্বর ২০২২ ২১:০১

ফাইল ছবি

বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের বৈঠকে দুই পক্ষই সম্মত হয়েছেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডিএমপির কর্মকর্তারাও। ওই বৈঠকে কোনো ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি করা হবে না বলে বিএনপির পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকেও কোনো ধরনের আগাম অ্যাকশনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তবে কোনো কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে বাড়াবাড়ি করলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। এ কারণে বুধবার (আজ) থেকে পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক বিশেষ নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হবে। এর আগে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও ওই মাঠে সমাবেশ করলে জনভোগান্তি কম হবে বলে জানানো হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আজ বুধবার রহমতগঞ্জ মাঠে বিএনপির সমাবেশের অনুমতি আসতে পারে বলে পুলিশ সদর দফতরের উচ্চপর্যায়ের সূত্র নিশ্চিত করেছে।


জানা গেছে, গত রোববার বিকেলে পুলিশ সদর দফতরে বার্ষিক পুলিশ সপ্তাহ নিয়ে বৈঠকে বসেন ঊর্ধ্বতনরা। সেখানে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় তাদের সমাবেশ করতে দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সেটা বিএনপির পল্টনের কার্যালয়ের বাইরে কোনো স্থান দেখতে গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতনরা। এ সময় বিএনপির পক্ষ থেকে আরামবাগ মাঠটি সমাবেশের বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে আরামবাগ মাঠের আশপাশে সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা ও স্কুল-কলেজ রয়েছে বলে নতুন কোনো মাঠের প্রস্তাব দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে পুলিশের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিকল্প মাঠের সন্ধানে নামে বিএনপি। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকালে রহমতগঞ্জ মাঠে সমাবেশ করলে সব ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব বলে ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়। এরপর বিএনপির প্রতিনিধিদের সঙ্গে গতকাল পুনরায় বৈঠকে বসেন পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে রহমতগঞ্জ মাঠে অনুমতি দেয়া সম্ভব বলে জানানো হয়। বিএনপিকে অনুরোধ করা হয় রহমতগঞ্জ ভেন্যু মেনে নেয়ার। পাশাপাশি মাঠটি তুলনামূলক অনেক বড় এবং সবধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব বলে বিএনপির প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে দু’পক্ষই ওই মাঠে সমাবেশ করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করা হবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে ধরপাকড় বন্ধ করার জন্যও পুলিশকে অনুরোধ করা হয়। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে শুধু যাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের জঙ্গি মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানানো হয়েছে। গতকালও বিশেষ অভিযানে ২৮৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের ডিসি ফারুক হোসেন জানান, ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে কোনোভাবেই রাস্তায় সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। তাদের কোনো না কোনো মাঠে সমাবেশ করতে হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখানে তারা সমাবেশ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এমন অবস্থায় বিএনপিকে নতুন কোনো স্থানের বিষয়ে দ্রুতই সিদ্ধান্ত জানানো হবে।


জানতে চাইলে বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী নয়া শতাব্দীকে বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ দলীয় কার্যালয় নয়াপল্টন অথবা আরামবাগ আইডিয়াল স্কুলের সামনে করতে চায় বিএনপি। কারণ ১০ ডিসেম্বর শনিবার ছুটির দিন। ওই দিন ওখানে আমরা প্রোগ্রাম করতে পারি। আমরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অনিরাপদ। সেখানে আমরা কোনো প্রোগ্রাম করব না। আমরা ডিএমপি কমিশনারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি। আমরা আশা বাদী, পুলিশ প্রশাসন এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে।

তিনি আরও বলেন, সমাবেশস্থল নিয়ে পুলিশের সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা চলছে। আলোচনায় রহমতগঞ্জ মাঠও রয়েছে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। চাহিদামতো বিকল্প ভেন্যু না হলে নয়াপল্টনেই অবস্থান নেবে বিএনপি। দায়িত্ব নিয়ে বলেছি, নয়াপল্টনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করব বা করতে চাই। আশা করছি, সেই সহযোগিতা আমাদের করবেন। না হলে সংশ্লিষ্টদের দায় নিতে হবে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বিএনপি লিখিতভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চায়নি। তারপরও কেন সরকার বা পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে অফার করছে আমরা জানি না। এখন আমরা মতিঝিলের আরামবাগে করতে চেয়েছি। সেখানেও সরকার ও প্রশাসনের আপত্তি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করব না— এটা দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কোথাও না করতে দিলে আমরা নয়াপল্টন অফিসের সামনে সমাবেশ করব— এখন পর্যন্ত এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।

বিএনপির পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া শতাব্দীকে জানান, বিএনপির নয়াপল্টনে সমাবেশের আবেদেনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে জননিরাপত্তা ও যানজটের বিষয় মাথায় রেখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৬ শর্তে অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু তারা পুলিশের এই সিদ্ধান্ত না মেনে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। পাশাপাশি তারা নতুন প্রস্তাবনা নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে যান। এরপর পুলিশ সদর দফতর থেকে গোয়েন্দারের নতুন কোনো ভেন্যুর সন্ধান করতে বলা হয়। যেহেতু তারা পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ করতে ইচ্ছুক এ কারণে সব দিক মিলিয়ে রহমতগঞ্জ ক্লাব মাঠে সমাবেশের বিষয়ে গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বিএনপির পক্ষ থেকেও সিদ্ধান্তটি মেনে নেয়া হয়েছে। এরপর পুরান ঢাকার ৪ স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করার কাজ শুরু করা হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সতর্ক রাখা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। সাদা পোশাকে মাঠে রয়েছে র‍্যাব-পুলিশের একাধিক সদস্য। এরই মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে ওই মাঠ পরিদর্শন করে নিরাপত্তার ছকও কষা হয়েছে।

জানা গেছে, এর আগে গত শনিবার বিকেলে জরুরি বৈঠকে বসেন ডিএমপি কমিশনার। ওই বৈঠকে ঢাকার ৮ ক্রাইম জোনের ডিসি ও গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা অংশ নেন। ওই বৈঠক শেষে রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল ও মেসে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সঙ্গে পাড়া-মহল্লায় অবস্থানরত বিএনপির হিটার কর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর রাতভর অভিযানে নামে গোয়েন্দা ও থানা পুলিশ। প্রথম দিন গ্রেফতার করা হয় ৪৭২ জনকে। তারা সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করছিল বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত রাখারও সিদ্ধান্ত রয়েছে। সব মিলিয়ে গত ৪ দিনে ১০১২ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।

তবে পুলিশের একটি সূত্র মতে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানোর তকমা লাগানো হলেও মূলত বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বাসায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। এছাড়া শিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা অবস্থান করে এমন মেসেও চালানো হয় অভিযান। এর আগে গত ২৯ নভেম্বর পুলিশ সদর দফতরের অপারেশন শাখার এক আদেশে দেশের সব পুলিশ ইউনিট প্রধান ও সব জেলার পুলিশ সুপারকে এ বিষয়ে অভিযান চালাতে বলা হয়। সেখানে বলা হয়, ঢাকার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিকে বিবেচনায় এই অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া মহান বিজয় দিবস, বড়দিন এবং থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপনের নিরাপত্তা নিশ্চিতও এই অভিযানের অংশ। ধারণা করা হচ্ছে, আবাসিক হোটেল, মেস, হোস্টেল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টারে অপরাধীরা লুকিয়ে থাকতে পারে। এ কারণে এসব স্থানে ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ তারিখ বিশেষ অভিযান চালানো হবে। এছাড়া সন্দেহভাজন বিভিন্ন স্থানেও অভিযান চালানোর পাশাপাশি জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী ও কারবারি, অবৈধ অস্ত্রধারী, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি গ্রেফতার, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করারও তাগিদ দেয়া হয়েছে ওই নির্দেশনায়।

জানা গেছে, চলমান অভিযানে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করলেও মূলত বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে এই তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে গত মাসের শুরুর দিকে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন জমা পড়ে পুলিশ সদর দফতরে। সেখানে বলা হয়, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। এরই পরিপ্রক্ষিতে সারাদেশে এই অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও বিএনপি সমাবেশের জন্য নয়াপল্টনে আবেদন করলেও পুলিশ ২৬ শর্তে তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয়। কারণ বড় মাঠে পুলিশের পক্ষে নজরদারি করা সম্ভব। কিন্তু নয়াপল্টনের বিএনপি পার্টি অফিসের আশপাশের গলিসহ জনবহুল এলাকায় কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে পুলিশের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশের বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ কারণে ঢাকার বিভিন্ন মেস, আবাসিক হোটেলে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত সপ্তাহের শেষের দিকে পুলিশের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায়ও এ বিষয়টি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। ওই সভায় দেশের সব ইউনিট ও পুলিশ সুপাররা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। সেখানে অভিযান চালানোর বিষয়ে সবাই একমত হন। এরপর ২৯ নভেম্বর এ বিষয়ে লিখিত আকারে নির্দেশনা জারি করা হয়।

সূত্র ঃ নয়াশতাব্দী


বিএনপি