ঢাকা সোমবার, ২৫শে আগস্ট ২০২৫, ১১ই ভাদ্র ১৪৩২


রোহিঙ্গাদের ফেরাতে কৌশল খুঁজছে সরকার


২৫ আগস্ট ২০২৫ ০৯:০৫

সংগৃহিত

রোহিঙ্গা সংকটের আট বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। মিয়ানমারের এই জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছিল এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। এটা ছিল সাময়িক। কিন্তু তাদের ফেরানোর পথ আজও উন্মুক্ত হয়নি। ফেরানো দূরের কথা, উলটো এখন মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি বাকি রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করছে। তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর হামলা চালাচ্ছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। এ কারণে প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নিচ্ছে। এমন এক বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর কৌশল নির্ধারণে রোববার থেকে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘নিরাপদ প্রত্যাবাসন’ এবং তাদের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে আলোচনা করা হয়। আজ সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্মেলনের শুরুতেই শতাধিক রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের অভিজ্ঞতা শুনেছেন অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক অতিথিরা।

এদিকে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি বাকি রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর জন্য নীতিগত এবং পুরোনো কৌশল অবলম্বন করছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইনে নতুন সংঘাত দেখা দিয়েছে। সেনা ও আরাকান আর্মির লড়াইয়ে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে সীমান্তে অবস্থান নিয়েছে। টিকতে না পেরে অসংখ্য রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছে। সুযোগ পেলেই সীমান্তের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কক্সবাজারের উপকূলবর্তী রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসরতরা জানিয়েছেন, মংডুর দক্ষিণের এলাকায় মিয়ানমার সেনারা অবস্থান করছেন। ড্রোন হামলা ও গোলাগুলিতে আতঙ্ক সৃষ্টি করছেন। অনেক রোহিঙ্গা লালদিয়া দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা বিজিবির কঠোর নজরদারির কারণে ব্যর্থ হয়েছে।

টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কিছু লোক সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। আমরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। যেসব পয়েন্টে প্রবেশের চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে টহল জোরদার করা হয়েছে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং গুজব ছড়িয়ে দালালরা রোহিঙ্গাদের এপারে আনার চেষ্টা করছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু : রোহিঙ্গা সংকটের আট বছর পূর্ণ হলেও কার্যকর সমাধান এখনো মেলেনি। প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে রয়েছে। তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এবং মানবিক সংকট মোকাবিলায় টেকসই সমাধানের পথ খুঁজতে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে। রোববার বিকাল ৫টায় উখিয়ার ইনানী সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন হোটেল বে-ওয়াচে সম্মেলন শুরু হয়। ‘টেক অ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শিরোনামে আয়োজিত সংলাপে ৪০টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। আয়োজক হিসাবে রয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হাই রিপ্রেজেনটেটিভের দপ্তর। এ সম্মেলনে পাঁচটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। আজ সকালে মূল অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কক্সবাজারে এই সম্মেলনকে ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠেয় রোহিঙ্গা সংকট সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে দেখা হচ্ছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা সংকটকে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরা জরুরি। সম্মেলনে ১০০ রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষকে ডাকা হয়েছে। তাদের বক্তব্য ও অভিজ্ঞতা শুনে বিভিন্ন দেশের অতিথিরা কার্যকর পদক্ষেপের প্রস্তাব দিতে পারবেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আগমন এবং সম্মেলনকে ঘিরে কক্সবাজারে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশছাড়ার কৌশল : আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মো. জোবায়ের যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি বাকি রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করছে। এভাবে বাড়ি ফেরানোর উদ্যোগ সফল হবে না, যদি না যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাতিসংঘ এক হয়ে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে বাধ্য করে এবং তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটির মহাসচিব এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, একটি ইউনিয়নেই প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। ৮ বছরে একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। বরং দেড় লাখের বেশি নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এটি কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা নয়, পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। নানা লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। এতে বিদেশি এনজিও, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল এবং স্থানীয় প্রশাসনের কিছু অংশের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। বরাদ্দ লোপাট ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেছেন, বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, শিগ্গিরই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রমকে দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কক্সবাজারে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। আজ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত থাকবেন, তাই সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা কঠোরভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে বোঝা কমানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ এককভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে পারবে না। তিন দিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে যে আলাপ-আলোচনা ও সুপারিশগুলো ওঠে আসবে, সেগুলো পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে।

যা বললেন রোহিঙ্গারা : আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভোটে নির্বাচিত কমিউনিটি প্রতিনিধি খিন মং-এর পাশাপাশি দুই রোহিঙ্গা তরুণী লাকি করিম ও উম্মে সালমার সঞ্চালনায় অধিবেশনে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের কণ্ঠে বারবার উঠে আসে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিনিধি মৌলভি সৈয়দ উল্লাহ বলেন, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে আমরা অনিশ্চিত জীবন নিয়ে বেঁচে আছি। মর্যাদার সঙ্গে দ্রুত আমাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারের আরকানে ফিরে যেতে চাই। বিশ্বকে আমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, যেন আমরা ঘরে ফিরতে পারি। বক্তব্যে তরুণ রোহিঙ্গা ফটোগ্রাফার সাহাত জিয়া হিরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশে থাকার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বের সামনে আমাদের কথা তুলে ধরার সুযোগ দেওয়ায় আমরা কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের জনগণের অবদান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী চিরকাল মনে রাখবে। এছাড়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের মধ্যে ফুরকান মির্জা, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, হুজ্জৌত উল্লাহ, আবদুল আমিন, আবদুল্লাহ, মুজিফ খান বক্তব্য দেন। প্রবাসী রোহিঙ্গারাও আলোচনায় অংশ নেন। অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান ও পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম। বিদেশি অতিথিদের মধ্যে ছিলেন মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি টমাস এইচ. অ্যান্ড্রুজ, জাতিসংঘের বাংলাদেশে আবাসিক প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স, মিয়ানমারের জন্য স্বাধীন তদন্তকারী মেকানিজমের প্রধান নিকোলাস কুমজিয়ান, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার অ্যাসিস্ট্যান্ট হাই কমিশনার রউফ মাজু।