ক্রিসেন্ট যেভাবে হাতিয়ে নিলো হাজার কোটি টাকা

ভুয়া রপ্তানির কাগজপত্র জমা দিয়ে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া বৈদেশিক বিনিময় বিল ক্রয় (এফডিবিপি) ও প্যাকিং ক্রেডিটে (পিসি) এ অর্থ লোপাটে বড় ভূমিকা রেখেছেন ব্যাংকটির অসাধু কর্মকর্তারা। এখনো তারা ব্যাংকটিতে বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। তবে গত সোমবার গ্রেপ্তারের জন্য দুদকের দল হানা দিলেও কাউকেই কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। ওই কর্মকর্তারা ছুটিতে আছেন বলে তাদের কার্যালয় থেকে জানানো হয়। এখন তাদের বরখাস্তের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে চিঠি ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চাইবে দুদক।
এরই মধ্যে দুদক তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের নামে বিল পাঠানো হয়েছিল তার অধিকাংশই ছিল গ্রুপটির নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। প্রতারণার মাধ্যমে এসব অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে গত রবিবার রাজধানীর চকবাজার থানায় পাঁচটি মামলা করেছে দুদক। তবে মামলায় জনতা ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিনুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন রাঘব-বোয়ালের নাম বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া ক্রিসেন্টের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও আসামি করা হয়নি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান তদারকি কর্মকর্তা দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল বলেন,‘প্রাথমিক অনুসন্ধানে আমরা ক্রিসেন্ট গ্রুপের সাত ও জনতা ব্যাংকের ১৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। এখন বিশদ পরিসরে তদন্ত হবে। তদন্তে আরও যাদের নাম আসবে তাদের সবাইকে চার্জশিটে আসামি করা হবে। তাছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা এসব ভুয়া বিল ক্রয়ে স্বাক্ষর করেছেন (সিগনেটরি অথরিটি) তাদেরও আসামি করা হবে। এর আগে বিসমিল্লাহ গ্রুপের মামলায় সিগনেটরি অথরিটিকে আসামি করা হয়েছে।’ এছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের পরিচালক ছাড়াও এ দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ক্রিসেন্টের অর্থ লোপাটে জড়িত জনতা ব্যাংকের ১৫ কর্মকর্তা হলেন-ঋণের নোট প্রস্ততকারী ও ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো.আব্দুল্লাহ আল মামুন,পরীক্ষাকারী মো. মনিরুজ্জামান,সুপারিশকারী মো.সাইদুজ্জামান,প্রিন্সিপাল অফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমীন (অফিসার ইনচার্জ এক্সপোর্ট),সিনিয়ার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. মাগরেব আলী (অফিসার ইনচার্জ এক্সপোর্ট),ব্যবস্থাপক (ফরেন এক্সপোর্ট)মো.খায়রুল আমিন,বাহারুল আলম, এজিএম মো.আতাউর রহমান সরকার,এস এম শরীফুল ইসলাম,ঋণ অনুমোদনকারী ডিজিএম (বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি)মো. রেজাউল করিম,শাখা প্রধান ও ঋণ অনুমোদকারী ডিজিএম মুহাম্মদ ইকবাল ও এ কে এম আসাদুজ্জামান,প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম কাজী রইস উদ্দিন আহমেদ, তৎকালীন জিএম বর্তমানে ডিএমডি মো.জাকির হোসেন ও বর্তমানে কৃষি ব্যাংকের ডিমডি ও তৎকালীন জনতা ব্যাংকের জিএম ফখরুল আলম।ওই কর্মকর্তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ ইকবাল বলেন,‘সোমবার আমরা ব্যাংকে অভিযান চালিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তাদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হবে। তাছাড়া তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার জন্য ব্যাংক কর্র্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হবে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫-১৮ সালের মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে এক হাজার ৭৪৫ কোটি ৬৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে ওই দুবাই, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাচার (মানিলন্ডারিং) করা হয়। ক্রিসেন্টের কাছে সুদে-আসলে ব্যাংকটির পাওনা (গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ৩ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। ঋণের পুরোটাই খেলাপি দেখিয়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে জনতা ব্যাংক। এর মধ্যে নিলামও ডাকা হয়েছে।
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, এসব জালিয়াতির ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন জনতা ব্যাংকের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ফখরুল আলম। বর্তমানে কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ডিমডি ফখরুল জালিয়াতির মাধ্যমেই বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।
ক্রিসেন্টের অর্থ লোপাট প্রসঙ্গে দুদক জানিয়েছে, বিক্রয় চুক্তির বিপরীতে রপ্তানি বিল কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণমঞ্জুরি ক্ষমতায় উল্লিখিত নির্দেশনা অনুযায়ী সন্তোষজনক ক্রেডিট রিপোর্ট ও বিদেশি ক্রেতার দৃঢ় রপ্তানি চুক্তির বিপরীতে ত্রুটিমুক্ত রপ্তানি দলিল ক্রয় করা যায়। এক্ষেত্রে লেনদেনের আগে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। পাশাপাশি চুক্তির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত হওয়াসহ প্রধান কার্যালয় থেকে বেশ কিছু শর্তও দেওয়া রয়েছে। কিন্তু জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা কোনোটিই করেনি।
অনুসন্ধান কর্মকর্তারা জানান, ফ্রেইড ফরোয়ার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়াইড শিপিং লাইন ও ইউরো এশিয়া শিপিং লাইন কর্তৃক ইস্যু করা এফসিআরের বিপরীতে রপ্তানি বিল কেনা হয়েছে। অধিকাংশ এলসির শর্ত অনুযায়ী ডকুমেন্ট প্রেজেন্টেশনের সঙ্গে অর্জিনাল বিল ফর লিডিং প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন সার্টিফিকেট, কুরিয়ার রিসিপ্ট, কপি অব অথরাইজড সুইফট মেসেজ, কান্ট্রি অব অরজিন সার্টিফিকেট দাখিল করার শর্ত রয়েছে। কিন্তু ক্রিসেন্ট গ্রুপ তা পালন না করেই রপ্তানি বিল দাখিল করে এবং জনতা ব্যাংক সেগুলো ক্রয় করে।
তারা আরও জানান, হংকং, থাইল্যান্ড ও দুবাইতে নিবন্ধিত সান পাউল লেদার ক্রাফট, বায়ো লিডা ট্রেডিং কম, মার্চেন্ট ট্রেড গ্যারান্টি ক্রোপ, ব্রাইট ভিউ জেনারেল ট্রেড সব প্রতিষ্ঠানেরই আফ্রিকান দেশ গাম্বিয়ার ব্যাংক এক্সিস ক্রেডিট ব্যাংক লিমিটেড থেকে ২২১টি আমদানি এলসি ইস্যু অযৌক্তিক ও সন্দেহজনক। অথচ গাম্বিয়ায় তাদের কোনো শাখা বা লেনদেন ছিল না। এছাড়া ব্যাংকটি বিপরীত নথি পাওয়ার পর জনতা ব্যাংক ইমামগঞ্জ শাখাকে ফেরত পাঠিয়ে নথি উপস্থাপনা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ মর্মে সুইফট মেসেজ পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন (আরএমএ ) না থাকায় ইমামগঞ্জ শাখা সুইফট মেসেজ আদান-প্রদান করতে পারে না। এ কারণেই তারা এক্সিস ক্রেডিট ব্যাংকের কাছে পেমেন্টের দাবি জানাতে পারবে না। এভাবেই ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ক্রিসেন্ট গ্রুপ হাতিয়ে নেয় ১,৭৪৫ কোটি টাকা।