এখনও এপিবিএন’র পাস ইস্যু করেনি বেবিচক, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্বরত প্রায় ৯ শতাধিক আর্মড পুলিশ সদস্যের নিরাপত্তা পাস এখনও ইস্যু করেনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বর্তমানে এপিবিএন সদস্যদের কাছে যে নিরাপত্তা পাস রয়েছে, তার মেয়াদও ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে যাবে। একইসঙ্গে এপিবিএন সদস্যদের এয়ারসাইডে (বিমানবন্দরের ভেতরে) দায়িত্বের বিষয়েও এখন পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত দেয়নি বেবিচক। এমন অবস্থায় বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই।
নিরাপত্তা পাস না পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখনও নতুন পাস ইস্যু করা হয়নি। কেন তারা (বেবিচক) দিচ্ছে না, সেটা তো তাদের বিষয়। এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এবং বেবিচকের নিরাপত্তা সংস্থা এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের (এভসেক) মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। আগে এয়ারসাইডে (বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে) ডিউটি করলেও ৫ আগস্টের পর থেকে সেখানে আর্মড পুলিশকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় বেবিচক। তাদের স্থলে নিয়োজিত করা হয় বিমানবাহিনীর সদস্যদের।
সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলেও এপিবিএন সদস্যদের আর ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বেবিচক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মূলত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যরা রানওয়ে এলাকায় অস্ত্র ও পোশাক ফেলে দ্রুত পালিয়ে যান। ফলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে বেকায়দায় পড়ে কর্তৃপক্ষ। সেই সময় দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিমানবাহিনীর ১৪০০ সদস্য নিয়োজিত করা হয়।
বিমানবন্দরের অ্যাপ্রন এলাকায় (যেখানে উড়োজাহাজ পার্ক, লোড-আনলোড কিংবা রিফুয়েলিং করা হয়) এপিবিএনের কমান্ড সেন্টার ছিল। গত ২৮ অক্টোবর রাতে সেটি দখলে নেয় এভসেক। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় ২৯ অক্টোবর একটি জিডিও দায়ের করে এপিবিএন। এরপর থেকেই মূলত দুটি সরকারি সংস্থার মধ্যে টানাপড়েন প্রকট আকার ধারণ করে। এরই মধ্যে দুটি সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক হলেও কার্যত কোনও অগ্রগতি হয়নি।
গত ১৮ নভেম্বর আগের ইস্যু করা ‘নিরাপত্তা পাস’ স্থগিতের সার্কুলার জারি করে বেবিচক। বেবিচকের সদস্য (সিকিউরিটি) এয়ার কমোডর মোহাম্মদ নাইমুজ্জামান খানের সই করা ওই সার্কুলারে বলা হয়, বেবিচকের এয়ারপোর্ট পাস নীতিমালা-২০২০ অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর থেকে আগের ইস্যু করা পাসগুলো স্থগিত ঘোষণা করা হলো। নিয়ন্ত্রিত টার্মিনাল, এয়ারসাইডে প্রবেশ ও দায়িত্ব পালনের জন্য ৩০ নভেম্বর থেকে বৈধ এভসেক আইডি সংবলিত পাস থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্ধারিত প্রক্রিয়া মেনে এভসেক আইডি নিতে বলা হচ্ছে। নতুন এভসেক আইডি সংবলিত পাস ছাড়া অন্য কোনও পাস নিয়ে বিমানবন্দরে কাউকেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
সার্কুলারে আরও বলা হয়, বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন বিভাগের কর্মী ও অন্য সংশ্লিষ্টরা (এয়ারলাইনসসহ অন্যান্য) নির্ধারিত প্রক্রিয়া মেনে এভসেক আইডির জন্য আবেদন করতে পারবে। এ ছাড়া এভসেক আইডি সংবলিত পাস ইস্যুর ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া নিয়ে এভসেক অফিসারদের প্রশিক্ষণ (যদি প্রয়োজন হয়) দিতে বলা হয়েছে।
জানা যায়, পাস ইস্যুর ব্যাপারে এপিবিএন থেকে লিখিত আকারে বলা হলেও এখন পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি বেবিচক।
এদিকে জানা গেছে, বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে (এয়ার সাইডে) দায়িত্ব পালনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বেবিচক সদর দফতরে চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়ার সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এপিবিএনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এয়ারসাইডে এপিবিএন সদস্যদের মোতায়েনের একটি পরিকল্পনা চাওয়া হয়। সেই পরিকল্পনা এপিবিএনের পক্ষ থেকে বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া হয়েছে। তবে সেটির মাস পেরিয়ে গেলেও কোনও উদ্যোগের কথা জানা যায়নি।
জানা যায়, এসব ঘটনা উল্লেখ করে সম্প্রতি আবারও বেবিচককে চিঠি দিয়েছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘২০১০ সাল থেকে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা দায়িত্বের পাশাপাশি ভিআইপি ও ভিভিআইপি, ভিভিআইপি বিমান, বিভিন্ন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বও পালন করে আসছে।’
সম্প্রতি এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ কারবারিদের আটক, ছিনতাইকারী এবং মানবপাচারকারী দুই জন চীনা নাগরিককে গ্রেফতার করেছে বলেও উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, এতে প্রতীয়মান যে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যা প্রতিরোধকল্পে ও যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশের কার্যক্রম ও গোয়েন্দা নজরদারি জরুরি। সেই লক্ষ্যে গত ১১ নভেম্বর বেবিচক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে সিভিল এভিয়েশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং এপিবিএন-এর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত আইজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় উপস্থিত সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের অভ্যন্তরে প্রতি শিফটে এপিবিএন ফোর্স মোতায়েনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এক মাসের বেশি সময় পার হলেও এ বিষয়ে কোনও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এছাড়া এপিবিএন ফোর্স এবং অফিসারের দায়িত্ব পালনে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের ভেতরে ও সংলগ্ন এলাকায় প্রবেশের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাসের মেয়াদ রয়েছে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, বিমানবন্দরে দায়িত্বরত অন্যান্য সংস্থার (কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, আনসার, বিমানবাহিনী, সিভিল স্টাফ, এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআই) নতুন পাস এরই মধ্যে ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু এপিবিএন সদস্যদের নামে পাস ইস্যুর জন্য সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও সন্তোষজনক কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। যার ফলে আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে বিমানবন্দরে প্রবেশের ক্ষেত্রে একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংস্থাটি শঙ্কা প্রকাশ করে উল্লেখ করেছে, ‘বিমানবন্দরে এপিবিএন সদস্যদের প্রবেশ রহিত হলে সার্বিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং সেইসঙ্গে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সংস্থা ও যাত্রীদের সেবা প্রদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের মাত্রাও বেড়ে যাবে।’
এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বলেন, ‘এখনও তারা (এপিবিএন সদস্য) নিরাপত্তা পাস পায়নি। তবে এটা আমরা প্রসেসে রেখেছি।’
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল ইসলাম বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা আবশ্যক। আমি মনে করি, বেবিচক ও এপিবিএনের কর্মকর্তারা বসে তাদের নিজেদের মধ্যে কোনও সমস্যা থাকলে সেটি ঠিক করে নেবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ে এ ধরনের মনোমালিন্য কোনও ঝুঁকি না বাড়ায়, সেদিকে উভয়পক্ষকে আন্তরিক থাকা উচিত।’