ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


বাংলা ক্রীড়া ধারাভাষ্য নিয়ে এতো সমালোচনা কেন?


৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২৩:২০

ক্রীড়া ধারাভাষ্য একটি সাধনালব্ধ শিল্প। বাংলাদেশে বাংলা ধারাভাষ্য শুরু হয় পাকিস্তান আমলে। দেশ স্বাধীন হবার পর এর কলেবর এবং শ্রী বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। স্বাধীনতার পরবর্তীতে বাংলাদেশে বেতার টেলিভিশনে বাংলা ধারাভাষ্যে যুক্ত ছিলেন বেশকিছু নামী ক্রীড়া ভাষ্যকার। তাদের অন্যতম হলেন-আবদুল হামিদ, মোহাম্মদ শাহজাহান, তৌফিক আজিজ খাঁন, বদরুল হুদা চৌধুরী, প্রফেসর খোদা বকশ মৃধা, আতাউল হক মল্লিক, প্রফেসর আতিকুজ্জামান, নূর আহমেদ, মনজুর হাসান মিন্টু, মোহাম্মদ মুসা প্রমুখ।

তারা প্রায় প্রত্যেকে তাদের ধারাভাষ্য ক্যারিয়ার শুরু করেন সত্তরের দশকে। প্রায় একসঙ্গে বিগত কয়েক বছর ধরে তারা সবাই গত হয়েছেন কিন্তু তাদের মোহনীয় কণ্ঠ, সাবলিল ধারাভাষ্য মানুষ আজো মনে রেখেছে শ্রদ্ধা আর ভলোবাসায়।

তাদের প্রত্যেকের ক্যারিয়ার প্রোফাইল স্টাডি করলে দেখা যায়, প্রায় সবাই মাঠ থেকে উঠে এসেছিলেন এবং পরবর্তীতে ধারাভাষ্যে যুক্ত হয়েছেন। তারা ছিলেন পুরোদস্তুর ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, রেফারী, আম্পায়ার অর্থাৎ ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে তাদের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তারা ছিলেন স্বশিক্ষিত, সুশিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত, রুচিশীল এবং ব্যক্তিত্ববান মানুষ। তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই লেখালেখির অভ্যাস ছিল। এই সামগ্রিক গুণাবলী এবং বৈশিষ্টের অধিকারী হওয়ার কারণেই তারা ধারাভাষ্যে ছিলেন প্রাণবন্ত এবং দক্ষ। আর সেকারনেই তারা প্রতিটি শ্রোতা/দর্শকের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছিলেন তাদের মনোমুগ্ধকর ধারাভাষ্য দিয়ে।

সম্প্রতি সরকারি গণমাধ্যমের পাশাপাশি বেসরকারি একাধিক রেডিও টিভি চ্যানেলে নানারকম ক্রীড়া ইভেন্ট সরাসরি সম্প্রচার করবার সুবাদে একসাথে প্রচুর ক্রীড়া ভাষ্যকারের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশে বাংলায় সুন্দর ও সাবলিল ধারাভাষ্য উপস্থাপনে সক্ষম ২০/২৫ জন মানসম্মত ক্রীড়া ভাষ্যকার নেই। তথাপি মেধাবী, যোগ্য এবং অভিজ্ঞরা অনেক ক্ষেত্রেই থেকে যাচ্ছেন লোক চক্ষুর অন্তরালে। প্রয়োজনীয় যোগাযোগ এবং পরিচিতির অভাবে যোগ্যরা অনেক ক্ষেত্রেই সুযোগ পাচ্ছেন না। তাইতো সম্প্রতি সাফ ফুটবলের টেলিভিশন সম্প্রচারে পরিবেশিত বাংলা ধারাভাষ্য নিয়ে নানারকম নেতিবাচক সমালোচনায় মুখর গণমাধ্যম এবং সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।

সত্যি বলতে কি বর্তমান প্রজন্মের ধারাভাষ্যকারদের অনেকের মধ্যেই পূর্বসুরীদের ন্যায় সম্মৃদ্ধ ব্যাকগ্রাউন্ড নাই। সারাবছর রেডিও কাজ করে হঠাৎ টিভির সাথে মানিয়ে নিতে পারেন না। তাই বেতার এবং টিভি উভয় মাধ্যমেই একই উপস্থাপনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এসব ভাষ্যকারদের অনেকেই আবার রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সুবিধা নেন। উপঢৌকন দিয়ে প্রযোজকদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। শেখার চেয়ে মঞ্চে মেরে দিব ধারনায় বিশ্বাসী তারা। দ্রুত তারকাখ্যাতি চান অনেকেই। কেউ কেউ আবার ধারাভাষ্যে যাত্রাপালার সংলাপ আওরান। সেটা আবার অনেকেই অনুকরণ করেন। অনেকেরই নেই মাঠের সম্পৃক্ততা, নেই প্রমিত উচ্চারণ, সবমিলিয়ে লেজে গোবরে অবস্থা। আর তাইতো ইদানিং বাংলা ধারাভাষ্য নিয়ে মানুষ নেতিবাচক সমালোচনায় মুখর। এই প্রজন্মে ভাল ভাষ্যকার নাই তা নয়, প্রয়োজনের তুলনায় সেই সংখ্যা নেহায়েত কম। যারাও আছেন, তারা আবার প্রচারের আলোয় না থাকায় সুযোগ পান না অনেক ক্ষেত্রে।

আমার মনে হয় আত্ম উপলব্ধির সময় এসেছে। আমরা যারা ধারাভাষ্য করি বা করছি তাদের মান বাড়ানোর প্রতি আরো যত্নবান হতে হবে। চ্যানেলগুলোকে আরো যত্নবান হয়ে তাদের ধারাভাষ্য প্যানেল গঠন করতে হবে। সেখানে যোগ্য, মেধাবী দক্ষ এবং অভিজ্ঞদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভাষ্যকার নিয়োগ না করে মেধা এবং যোগ্যতার সঠিক মুল্যায়ণ করতে হবে। এখানে পেশাদারিত্ব এবং স্পেশালাইজেশন গড়ে তুলতে হবে যাতে প্রাক্তন খেলোয়াড়রা এই সেক্টরে আসতে আগ্রহী হন। তাহলে বাংলাদেশের ফুটবলের ন্যায় এদেশের বাংলা ধারাভাষ্যও ফিরে পাবে তার সুদিন এবং হারানো ঐতিহ্য। তখন বাংলা ধারাভাষ্য শুনে মানুষ বিরক্ত নয়, বিমোহিত হবে এবং উপভোগ করবে।

মো. সামসুল ইসলাম, ক্রীড়া ভাষ্যকার

 

এমএ