ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১


অন্ধকার ঘোচাতে চাই সাংস্কৃতিক জাগরণ


১০ আগস্ট ২০১৯ ২০:৫১

যখনই যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা নিলেও সাংস্কৃতিক বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। অথচ বঙ্গ সংস্কৃতি এক উত্তরাধিকারের ঐতিহ্য নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচিত। পাকিস্তানিরা যেহেতু বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করত, সে কারণে প্রথমেই তারা আমাদের মাতৃভাষার ওপর চড়াও হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলছে, পাকিস্তান আমলে গোটা দেশের জনসংখ্যায় আমরাই ছিলাম বেশি। শুধু বেশিই না, অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট শেষ হয়ে গেলে দ্বিজাতিতত্ত্বের তকমা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছিল পশ্চিম অধ্যুষিত। তাই বাংলা ভাষা ও বাংলার মানুষকে অধিকারহীন করে রাখার চক্রান্ত রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার আগ থেকেই চালিয়ে যাচ্ছিল। শাসকগোষ্ঠীর বৈরী আচরণের বিরুদ্ধে তাই বাংলার তরুণ ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে মুসলিম লীগ সরকারের গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েও মাতৃভাষার সল্ফ্ভ্রম রক্ষা করেছিল। কিন্তু তা হলেই-বা কী, ২৩ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের যে নির্যাতন-অবহেলা করেছিল, তারই যূথবদ্ধ ক্ষুব্ধ প্রকাশ চরমভাবে দেখা দিল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে।

৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসমুদ্রে অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। এই একটি বাক্যে বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে সাহসের মোড়কে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, তারই বিস্টেম্ফারণ ঘটল ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ নেতার নির্দেশকে শিরোধার্য করে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। প্রতিবেশী ভারত, সুদূরের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নসহ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করা সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সমর্থন নিয়ে মুক্তিফৌজ রণাঙ্গনে লড়েছিলেন ৯ মাস, তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধের এই মহানায়ক সব গণতান্ত্রিক শক্তি ও রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জন করেছিলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিফৌজের যৌথ কমান্ড মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায়।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত স্বদেশে ফিরে এলেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাকে পুনর্নির্মাণের কাজে একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করলেন। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার সমর্থকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গোড়া থেকেই যে চক্রান্ত করে যাচ্ছিলেন, তারই নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ ঘটল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। কিন্তু শাহাদাতবরণের আগে বঙ্গবন্ধু যে সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন, তাতেই তিনি আমাদের মাতৃভূমিকে 'সোনার বাংলায়' রূপান্তরিত করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক তৎপরতা এবং দেশ পুনর্নির্মাণে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু সবকিছুর সঙ্গে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার, চর্চা এবং দেশ ও বিদেশে উপস্থাপনার উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে রূপান্তরিত করলেন ১৯৭৪ সালে। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতিকে যথার্থরূপে তুলে ধরে তাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। দেশের সর্বত্র এই শিল্পকলা চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই এ ধরনের সংস্কৃতি কেন্দ্র জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কার্যক্রমও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার পর সেই কর্মচঞ্চলতা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর তারপর থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচএম এরশাদ রাষ্ট্র পরিচালনায় যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে গেছেন তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, তাতে রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব সমাজে পরিলক্ষিত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে চরম অবহেলা দেখা যায় এবং এ কারণেই এই শাখার কোনো উন্নতি সামরিক শাসনের সময় হয়নি। বিএনপি শাসনামলে খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে ও তার সমন্বয় কমিটিকে যেভাবে হেনস্তা করতে চেয়েছিলেন তাতে বাংলার মাটিতে উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হলো পুনর্বার। তাই আমরা দেখেছি সংস্কৃতি অঙ্গনকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে ধরনের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল, তা আদৌ হয়নি। বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত হারানো সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের কাজ মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলার নিজস্ব আদি সম্পদ যাত্রা ও পালাগান আজ তো প্রায় উঠেই গেছে। আগে যেমন খোলা ময়দানে অথবা ধানকাটা শেষে বিস্তৃত ফসলের মাঠে যাত্রার আয়োজন হতো এবং সারারাত ধরে গ্রামবাসী নারী-পুরুষ সেই যাত্রাপালা উপভোগ করতেন, আজ আর তেমন কোনো আয়োজন দেখি না বহুকাল। অজুহাত নিরাপত্তার অভাব। সংস্কৃতি জাতীয় জীবনের একটি মৌলিক উপাদান। এ ক্ষেত্রে আমাদের সম্পদ অপার। কিন্তু পুলিশি প্রহরার ব্যর্থতার কারণে আজ স্থানীয় মাস্তান বাহিনীর অপকীর্তিতে এই অনুষ্ঠানগুলো ক্রমে বন্ধ হয়ে গেছে। এর কোনো প্রতিকার আজও হয়নি। তবে শিল্পকলা একাডেমি যাত্রা সংশ্নিষ্ট নেতৃবৃন্দের সহায়তায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে বহুবার বৈঠক করেছে এবং নানা বিকল্পের পরামর্শ দিয়েছে।

শুধু যাত্রাপালাই নয়, দেশে আজ অগণিত সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি সংগঠন রয়েছে। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক, নৃত্যকলা ও কণ্ঠসঙ্গীত পড়ানো হচ্ছে। অথচ দেশে নাট্য আন্দোলন একসময় যেমন তুঙ্গে উঠেছিল, অনেক ক্ষেত্রে অন্ধকার দূরীকরণে ব্যাপক অবদান রেখেছে, আজ তার অবস্থা কেমন যেন বেহাল। নৃত্যকলা বিভাগের কথা কী আর বলব। বিদেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী এ পর্যন্ত নানা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরেছেন; কিন্তু তাদের অনেকেই বাংলায় নাচের নানা উপকরণ থাকা সত্ত্বেও 'নিজস্ব নৃত্যধারা' তৈরি করতে পারেনি। এ ব্যাপারে সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেছেন বলে আমি অন্তত জানি না। এমনকি আমাদের জীবনের প্রধান দুটি লড়াই- এক. ভাষা আন্দোলন ও দুই. মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ দুই অধ্যায়ের প্রেক্ষাপট ও রক্তস্নাত অধ্যায় আমলে নিয়ে নৃত্যকলায় কোনো মৌলিক কাজ হয়নি অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য আজ পর্যন্ত কেউ প্রযোজনা করতে পারেননি। এদিকে ফিউশন নামে শিখে আসা বিদ্যার সঙ্গে লোকনৃত্যের মুভমেন্টকে কাজে লাগিয়ে কী অদ্ভুত ধরনের নাচ তৈরি করেছেন, যা দিয়ে তারা মঞ্চ মাতাতে চেষ্টা করেন।

কণ্ঠসঙ্গীতের কথা কী বলব। এর জন্য বিস্তৃত পরিসর দরকার। তবু বলি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুশীলন এবং সঙ্গীত উৎসব একেবারেই হচ্ছে না। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দুয়েকটি বাদে সবাই এ ক্ষেত্রে অনীহাই দেখিয়ে যাচ্ছেন। যে গণসঙ্গীত পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মানুষকে লড়তে প্রস্তুত করেছিল, সেই গণসঙ্গীত যে দেশের শত্রু নিধন ও দেশ বিনির্মাণে কাজে লাগতে পারে, তা ভুলে গিয়ে বিশেষ বিশেষ দিবসে কোনো কোনো পুরনো গণসঙ্গীত পুনঃপ্রচার করে গণমাধ্যমগুলো তাদের দায়িত্ব সারছে। দেশে কোনো নতুন গণসঙ্গীত রচনা হচ্ছে না অর্থাৎ এদিকটায় মনোযোগ খুব কম। রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি পরিপূরক হিসেবে যে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম মানুষ গড়ে তুলেছিলেন এবং তোলেন, তার কি প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে? আমার তো ধারণা, আমাদের যথার্থ সংস্কৃতি চর্চা না হওয়ার কারণেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতায় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতা ক্রমে জাতিকে অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরার অপচেষ্টা।

আমাদের সংস্কৃতিকে শুধু রক্ষাই নয়, এর ব্যাপক প্রসারে পুনঃমনোযোগ বাড়াতে হবে। জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদসহ সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে সামাজিক অনাচার ও নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোর দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এ দাবি দীর্ঘদিন থেকেই করা হচ্ছে। কিন্তু কেন জানি না কোনো সরকারই এই দাবির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করছে না। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী তৎপরতা, সামাজিক নানা দুস্কর্ম এবং নানা ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চার কোনো বিকল্প নেই, এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে। আমাদের সংস্কৃতির যে পুষ্ট ধারা এর গতিশীলতা, বেগমানতা আমাদের নির্মাণের ভূমি করতে পারে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ ও সুন্দর। আমাদের জাতীয় জীবনের এই মৌলিক উপাদান নিয়ে দ্রুত ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।

লেখক: কামাল লোহানী, প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব