রাত হলেই আতঙ্ক নামে টাঙ্গাইল সড়কে
রাত হলেই আতঙ্ক নামে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। এই সড়কটি বাসে চলাচল করা নারীদের জন্য হয়ে উঠেছে একটি আতঙ্কের সড়ক। পর্যাপ্ত পুলিশি টহল ও সড়ক বাতি না থাকায় অপরাধীরা যেন এই সড়কটিই বেছে নিয়েছেন।
গত ছয় বছরে এই সড়কে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয় এক ছাত্রীকে। এছাড়া এক পোশাক শ্রমিককেও ধর্ষণ করা হয় চলন্ত বাসে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার একই সড়কে ডাকাতিসহ এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ময়মনসিংগামী প্রান্তিক পরিবহনের কয়েকজন যাত্রী জানান, যেভাবে প্রতিনিয়তই এই সড়কে চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এতে করে তারা আতঙ্কিত।
জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার দত্তবাড়ি গ্রামে খালার বাড়িতে যান এক পোশাক শ্রমিক। পরদিন শুক্রবার ভোরে গাজীপুর যাওয়ার উদ্দেশে বিনিময় পরিবহনের বাসে ওঠেন ওই নারী। বাসে আর কোনো যাত্রী না নিয়ে গেট বন্ধ করে দিয়ে মধুপুর এসে তারা বাস ঘুরিয়ে ময়মনসিংহের দিকে যেতে থাকে। মধুপুর বনের কোনো এক নির্জনস্থানে বাস থামিয়ে তারা ওই নারীকে ধর্ষণ করে। পরে ধর্ষণের পর শোলাকুড়ি রাস্তায় ফেলে দেয়। পরে ওই নারী মধুপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে অন্য একজনের ফোন দিয়ে ঘটনাটি তার স্বামীকে জানায়। তার স্বামী গাজীপুর থেকে এসে তাকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওই নারীর স্বামী বিষয়টি শ্রমিক ফেডারেশনের নেতাদের জানায়। বিষয়টি আপস রফা করতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা ও চাপ দিতে থাকে পরিবহন নেতারা। আপস রফা ও দোষীদের শাস্তির কথা বলে দিনভর তার সঙ্গে টালবাহানা করে বলেও জানান তিনি। পরে নির্যাতিতার স্বামী বাদী হয়ে তিনজনের নামে মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই বাসের চালক ও দুই সহকারীকে গ্রেফতার করে। এরা হচ্ছেন-চালক নয়ন ও তার দুই সহযোগী রেজাউল ও আব্দুল খালেক। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
এদিকে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রূপা খাতুন নামে এক নারীকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে একই সড়কের বন এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। রূপা একটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী ছিলেন।
মধুপুর থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কবরস্থানে দাফন করে। ২৭ আগস্ট নিহতের বড় ভাই পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে মরদেহের ছবি দেখে বোনকে শনাক্ত করেন। ৩১ আগস্ট মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই দিন রাতেই তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামের কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় ছোঁয়া পরিবহনের চালক হাবিবুর (৪৫), চালকের সহকারী শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীরকে (১৯) ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। বাসের সুপারভাইজার সফর আলীকে (৫৫) সাত বছরের কারাদণ্ড দেন টাঙ্গাইল জেলা আদালত।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়া থেকে ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনটি রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকার দিকে যাত্রা শুরু করে। রাতে নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে যাত্রী ওঠানোর নিয়ম না থাকলেও রাত ১১টায় সিরাজগঞ্জ থেকে প্রথমে চারজন এবং পরে দুই বার তিনজন করে ছয়জন বাসে ওঠেন। বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলপ্লাজা পার হওয়ার পর ১০ জন ডাকাত অস্ত্রের মুখে বাসের ২৪ জন যাত্রীকে জিম্মি করে ফেলে। এসময় ডাকাতরা পুরুষ যাত্রীদের পরনের কাপড় খুলে ও নারী যাত্রীদের জানালার পর্দা দিয়ে হাত, পা, মুখ ও চোখ বেঁধে ফেলে মারধর করতে থাকে।
এরপর নয়জন ডাকাত যাত্রীদের সিটের সামনে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পরে তারা কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবার মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুটে নেয়। বাসটি দেলদুয়ার উপজেলার নাটিয়াপাড়া এলাকায় পৌঁছালে গাজীপুর থেকে ঢাকা রুটে চলাচলকারী ঝটিকা সার্ভিসের চালক ডাকাত দলের সদস্য বাসটির মূল চালককে সরিয়ে তিনি চালকের আসনে বসে বাসটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এরপর বাসটি গোড়াই এলাকায় মহাসড়কে ইউটার্ন নিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে যেতে থাকে। রাস্তায়ই গাড়ির মধ্যে এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করে ডাকাতরা।
ওই বাসের যাত্রীদের বরাত দিয়ে গত বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের এই বর্ণনা দেন।
তিনি জানান, ডাকাতদলের এক সদস্যের নানির বাড়ি মধুপুরে। ভোরে ডাকাতরা মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়া নামক স্থানে বাস থেকে নেমে ওই বাড়িতেই আত্মগোপনে ছিলেন। পরে সেখান থেকে তারা পালিয়ে যান। এ ঘটনায় ডাকাত দলের সদস্য রাজা মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বল্লা গ্রামের হারুন অর রশীদের ছেলে। রাজা টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা রুটে চলাচলকৃত ঝটিকা বাস সার্ভিসের চালক। আর এই বাস চালানোর পাশাপাশি ডাকাত দলের অন্যতম সদস্য।
গ্রেফতার রাজা পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি বাস চালাচ্ছিলেন আর তার নয় সহযোগী যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করছিলেন। এছাড়া কয়েকজন মিলে এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণও করেন।
এ ঘটনায় ঈগল পরিবহনের যাত্রী কুষ্টিয়ার হেকমত আলী বাদী হয়ে ১০ জনকে আসামি করে ডাকাতি ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছেন।