ঢাকা বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


অর্থনীতি এগিয়ে নিয়েছে শিল্পখাত


১৯ মার্চ ২০২১ ১৭:২৮

প্রতিকি

একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পর্যালোচনা করে তখন বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষিখাতের অবদান ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং শিল্পখাতের অবদান মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থনীতির সেই চিত্র ৫০ বছরে পাল্টে গেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে দেশের অর্থনীতি এখন শিল্প ও সেবা খাতমুখী। দেশের অর্থনীতিতে কৃষিকে টপকে শিল্পখাত এগিয়ে গেছে বহুদূর। প্রতিবছরই জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) বেড়েই চলেছে শিল্পখাতের অবদান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০০০-০১ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে শিল্পখাতের অবদান ছিল ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশে। ২০১০-১১ অর্থবছরে শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশে। বর্তমানে শিল্পখাতের অবদান প্রায় ৩৫ শতাংশ, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোই বদলে দিয়েছে।

১৯৭২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্নিমাণ’ শীর্ষক দুটি প্রতিবেদন তৈরি করে বিশ্বব্যাংক। প্রথম খণ্ডে ছিল সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা এবং দ্বিতীয় খণ্ডটি যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পখাতের অবদান কয়েক গুণ বেড়েছে। শিল্পবিপ্লবের ৮০ বছরে ইংল্যান্ড জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ২০ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করেছিল। সেই হিসাবে বলা যায়, বাংলাদেশেও ছোটখাটো শিল্পবিপ্লব হয়েছে।’

দেশে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ওষুধ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী। পোশাক শিল্পের পর অর্থনীতিতে আইটি শিল্পের অবদান দ্রুতই বাড়ছে। এরইমধ্যে আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে অভূতপূর্ব সুনাম অর্জন করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ২০১৯ সালে দেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের আয় ১০০ কোটি ডলার বলে জানিয়েছিলেন। যা ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ছিল মাত্র ১০ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি বছর নাগাদ এ আয় ৫০০ কোটি ডলারে উত্তীর্ণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য দেশব্যাপী ২৮টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে।

জিডিপির হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ৩৩তম। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ধারণা, ২০৩০ সালের ভারত ও চীনের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৬তম অর্থনীতির দেশ। আইএমএফ বলছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির গতিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। বিশ্বের ১১টি দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন (এইচএসবিসি)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। এর পরের পাঁচ বছর ২০২৩ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ হারে। আগামী এক যুগ বাংলাদেশে গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে। আর বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বের সব দেশের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে শিল্পখাতের অবদান হবে অগ্রগণ্য। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ অর্থবছরে শিল্পখাতে সবচেয়ে বেশি ১২ দশমিক ০৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কৃষিখাতে ৪ দশমিক ১৯ আর সেবাখাতে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

দূর করতে হবে সব প্রতিবন্ধতা : অর্থনীতিবিদদের মতে, শিল্প ছড়িয়ে যাচ্ছে না। শিল্প একটা খাতের মধ্যে রয়ে গেছে। এটা সস্তা শ্রমভিত্তিক রপ্তানিমুখী শিল্প। তাই আরো অন্যান্য খাতে গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। এছাড়া সনাতনী পণ্য বাদে উদীয়মান পণ্য আসা উচিত বলে মনে করেন তারা। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্পখাতের অবদান ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা ঠিক তার উল্টো। শিল্পখাতের অবদান কম থাকায় প্রবৃদ্ধির গতিও থাকে কম। তাই মধ্য আয়ের স্বপ্ন পূরণে শিল্পখাতের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই আগামী বাংলাদেশের। দেশের অর্থনীতির অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে ঘুষ দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম। রয়েছে জটিল নীতিমালা এবং ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনের খারাপ দৃষ্টান্ত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব দূর করতে পারলে দেশ আরো অনেকদূর এগিয়ে যেতো বহু আগেই।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিল্পে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে সেটা সরকারের নানারকম প্রণোদনার কারণে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতিলাভের পর এখন যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো উঠে যাবে। বাজার তখন আমাদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে। শুধু সস্তা মজুরি এবং সরকারের প্রণোদনা দিয়ে টিকে থাকা যাবে না। আমাদের রেগুলেটরি বডি এবং প্রমোশনাল বডির ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। এদের ভূমিকার ওপর আমাদের শিল্পের উন্নতি অনেকটাই নির্ভর করে।’ দেশের শিল্পখাত কর্মসংস্থান তেমন অবদান রাখতে পারছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিল্পে রপ্তানি হয়তো বেড়েছে সেটি নানারকম প্রণোদনার কারণে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি আমাদের চাকরির বাজার সম্প্রসারণে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। অনেকে শিল্পে জিরো এমপ্লয়মেন্ট গ্রোথ বলছে। যদিও আমি শূন্যের কোটায় বলতে চাইনা। এখনো ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো অনেকটাই উপেক্ষিত। কিন্তু ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো এখনো উন্নতি করতে পারেনি। আর একদিকে উন্নতি হলে অন্যদিকে অবনতি হচ্ছে। এটা খারাপ লক্ষণ। সমতা নিশ্চিত হচ্ছেনা। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বড় বড় শিল্পের পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি শিল্পের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ধীরগতিতে হলেও কৃষিপ্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশে পরিণত হচ্ছে, যা মধ্যম আয়ের অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হওয়ার অন্যতম পথ। কিন্তু টেকসই শিল্প খাত ছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষায় শিল্পায়ন প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব হওয়ার ওপরও জোর দিয়েছেন তারা। ২০১৬ সালে জাতীয় শিল্পনীতি প্রণয়ন করেছে সরকার। ফলে দেশে জ্ঞানভিত্তিক শিল্পায়নের নতুন ধারা সূচনা হয়েছে। এসএমই খাতের উন্নয়ন, গুণগত মান অবকাঠামো সৃষ্টি, মেধাসম্পদের সুরক্ষা, শিল্প উদ্ভাবন, অ্যাক্রেডিটেশনসহ শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুঘটকগুলোর অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। এতে দেশের শিল্পখাত উজ্জীবিত হচ্ছে। এরইমধ্যে সরকার শিল্পখাতের প্রসারে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা ও নীতিমালা সহজীকরণসহ দীর্ঘমেয়াদি নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।