ঢাকা শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

সর্দার রতনের নেতৃত্বে ডাকাতি ও ধর্ষণ


৯ আগস্ট ২০২২ ০৩:৫৩

ছবি- ডাকাত সর্দার রতন

টাঙ্গাইলের মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতির সময় দুর্বৃত্তরা এক নারীকে ধর্ষণ করেছে। এছাড়াও একাধিক নারীর শ্লীলতাহানি করে তারা। এ ঘটনার মূলহোতা ও ডাকাত সর্দার রতন হোসেনসহ চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব। গত রোববার রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‌্যাব বলছে, ডাকাত দলে রতন, রাজা ও মান্নানের গ্রুপের ১৩ জন ছিলেন। রতনের পরিকল্পনায় রাজা ও মান্নান দল গোছানোর কাজ করেন। গ্রেপ্তার চক্রের সদস্যদের বয়স ২১ থেকে ২৩ এর মধ্যে। ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১২, ১৪ যৌথ অভিযান চালিয়ে রতনসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে।

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মূল পরিকল্পনাকারী মো. রতন হোসেন, তার সহযোগী মো. আলাউদ্দিন, মো. সোহাগ মন্ডল, খন্দকার মো. হাসমত আলী ওরফে দীপু, মো. বাবু হোসেন ওরফে জুলহাস, মো. জীবন, মোঃ আব্দুল মান্নান, মো. নাঈম সরকার, রাসেল তালুকদার, মো. আসলাম তালুকদার ওরফে রায়হান। এ সময় ডাকাতিতে ব্যবহৃত ২০টি মোবাইল, ১৪টি সিম, ক্ষুর উদ্ধার করা হয়। আর লুট হওয়া দুটি রূপার চুড়ি উদ্ধার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে র‌্যাব জানায়, বাস ডাকাতির তিন দিন আগে রতন ডাকাত রাজা মিয়াকে বাস ডাকাতির প্রস্তাব দিলে রাজা মিয়া দলের অন্যান্য ডাকাতদের সংঘটিত করার কথা বলেন। পরবর্তীতে রতন, মান্নান, জীবন, দীপু, আউয়াল ও নুরনবীকে বিষয়টি জানায়। মান্নান তার সহযোগী সোহাগ, আসলাম, রাসেল, নাঈম ও আলাউদ্দিনকে নিয়ে ডাকাতিতে যোগ দেয়। ডাকাতিতে রতনের নেতৃত্বে ১৩ জন অংশ নেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রতনের নেতৃত্বে গত ২ আগস্ট দুপুরবেলা গাজীপুরের জিরানী বাজার এলকায় সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বাসে ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। মূল পরিকল্পনাকারী রতন ডাকাতির কাজে যাবতীয় প্রস্তুতির জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেন। পাশাপাশি ১৩ জনের দলটিকে ছোট ছোট করে ভাগ করে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী রতন টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মোড়ের একটি দোকান থেকে ৪টি চাকু, দুটি ধারালো কাঁচি ও একটি ক্ষুর কেনেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২ আগস্ট রাতে ডাকাত রাজাসহ চক্রের অন্যান্য সদস্যরা সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। রাত একটার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি বাস সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় পৌঁছালে ডাকাত রাজা বাসটিকে থামার সংকেত দেন। যাত্রীবেশে প্রথমে রতন, রাজা, মান্নান ও নুরনবী বাসটিতে ওঠেন। পরবর্তীতে আরও দুই দফায় ডাকাতচক্রের অন্য সদস্যরা বাসটিতে যাত্রীবেশে আরোহন করেন। বাসটিতে ২৪ জন সাধারণ যাত্রী থাকায় ডাকাত চক্রের অধিকাংশ সদস্য বাসের পেছনের দিকে বসেন। বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকা পার করলে রতন ডাকাত দলের সদস্যদের চাকু ও ধারালো কাঁচি দেন। আউয়াল ডাকাত ধূমপানের কথা বলে বাসের গেটের কাছে যান এবং অন্যান্যদের ইশারা প্রদান করলে রাজা, রতন, মান্নান ও নূরনবী ড্রাইভিং সিটের কাছে গিয়ে ড্রাইভারকে মারধর করেন। চালককে মারধর করে রতন বাসের ড্রাইভিং সিটে বসে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেন। ডাকাত দলের বাকি সদস্যরা বাসের চালক ও সুপারভাইজার, হেলপারসহ অন্যান্য সাধারণ যাত্রীদেরকে হাত মুখ বেঁধে সিট কভার দিয়ে মুখে মুখোশ পড়িয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে দেন এবং যাত্রীদের সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেন। এই সময়ে তারা দুই নারীকে শ্লীলতাহানী ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটান। পরবর্তীতে টাঙ্গাইলের হাঁটুভাঙ্গা মোড় হয়ে মধুপুরে যাওয়ার পথে মধুপুরের রক্তিপড়া এলাকায় রতন গাড়ি চালনার সময় লুটকৃত মালামাল নিয়ে ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার কারণে রতন পেছনে তাকালে বাসটি রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক খুঁটি ও বালুর সঙ্গে বাসের সংঘর্ষ হলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একপাশে হেলে পড়ে। তখন ডাকাতদলের সবাই মালামালসহ বাস থেকে নেমে পালিয়ে যান।

খন্দকার আল মঈন বলেন, দুর্ঘটনার পর ডাকাত দলের সদস্যরা বাস থেকে নেমে টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় যান। সেখান থেকে অটোরিকশায় করে মধুপুরের কুড়ালিয়া এলাকায় রতনের এক আত্মীয়ের ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে লুণ্ঠিত মালামাল নিজেদের মধ্যে বণ্টন করেন। ভাগাভাগি শেষে রতন গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় আত্মগোপন করেন। দলের অন্য সদস্যরা যে যার মতো আত্মগোপনে চলে যান।

ডাকাত চক্রের সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন জানান, রতন হোসেন ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি পেশায় গাড়ির হেলপার। তার বিরুদ্ধে পূর্বেও ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে। গ্রেপ্তার রতন ২০১৮ সালে গ্রেপ্তারকৃত নূরনবী, জীবন ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে সাভার পরিবহনের একটি বাস ডাকাতি করেন। ওই বাস ডাকাতির ঘটনায় রতন গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে ২০২০ সালে পুনরায় নূরনবী, জীবন ও আউয়ালকে নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি অটোরিকশা ছিনতাই করেন। তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা জীবনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জীবন গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় এক বছর কারাভোগ করেন। কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে আবারও দল নিয়ে সাভার, গাজীপুর বা সিরাজগঞ্জ এলাকায় মহাসড়কে আরও বেশ কয়েকটি ডাকাতি করেন। রতনের অন্যতম সহযোগী জীবন পেশায় গাড়ির হেলপার। হেলপার পেশার আড়ালে সে বেশ কয়েকটি পরিবহন ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে। টাঙ্গাইলে ডাকাতির ঘটনায় তিনি যাত্রীদের মালামাল লুটের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এরআগেও জীবন ২০১৮ ও ২০২০ সালে দুটি ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করার তথ্য পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইল মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় একাধিক ধর্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের মুখপাত্র জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত অনেকেই ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। মামলার এজাহারেও দলবেঁধে ধর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ আছে। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে তাদের হাজির করে জবানবন্দিতে জানতে পারবেন কে কে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত। তদন্তে জানা যাবে কতজন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসে কাউন্টার ছাড়া যাত্রী তোলার বিষয়ে খন্দকার মঈন বলেন, পথিমধ্যে যাত্রী তোলা ঝুঁকিপূর্ণ। যাত্রীদের সঙ্গে থাকা ব্যাগে অস্ত্র থাকতে পারে। এমন কি তারা কাউন্টার থেকে টিকিট ছাড়াই তোলা হচ্ছে। মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে।