ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


দৌড় প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়ে গেল আমার বন্ধু


২০ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:২৯

এতদিন স্মৃতিগুলো আমাদের কাছে মধুর ছিল। দেখা হলেই একে অপরের সঙ্গে তুমুল মজা হতো ওসব স্মৃতিতে ফিরে গিয়ে। প্রতিবারই আমরা হয়ে উঠতাম জুবলী রোডের দুরন্ত দুই কিশোর।

বাচ্চুকে নিয়ে আমার স্মৃতির ‘ভার’ এতবেশি, সেটা এখন আর বইতে পারছি না। কারণ, এতদিন আমরা ভাগাভাগি করে স্মৃতিগুলোকে বয়ে বেড়াতাম। আর আজ থেকে সব স্মৃতি ও আমার কাছে রেখে উড়াল দিল। এ ভার কতটা ভয়ঙ্কর, সেটা বলে প্রকাশ করা যাবে না।

‘ব্যান্ড ৭৭’ দিয়ে ও আমার সহযাত্রী। সে হিসাবে ৪১ বছরের পথচলা আমাদের। তার পর ’৭৮ সালে ওকে আমি নতুন ব্যান্ড ‘ফিলিংস’-এ নিয়ে আসি। ’৮২ সালে আমি ওকে ফেলে ঢাকায় চলে আছি। সলো ক্যারিয়ার শুরু করি। একই বছর ও জয়েন করে ‘সোলস’-এ। এর পর সেও ঢাকায় চলে আসে। এখানে এসে আবার আমরা একসঙ্গে। একই বাসায়, একই খাটে আমাদের সহস্র রাত-দিন কাটে।

দিন-রাত আমরা একসঙ্গে প্র্যাকটিস করছি। মিউজিক নিয়ে নানা স্বপ্ন নানা পরিকল্পনা আমাদের। আসলে ঢাকা-চট্টগ্রামের এমন কোনো জায়গা নেই, অলি-গলি নেই যেখানে সুন্নতে খৎনা থেকে গায়ে হলুদের শো করিনি।

শুরু থেকেই বাচ্চুর মধ্যে যেটা প্রকট ছিল খুব সহজে মানুষকে আপন করে নেওয়া। মিউজিক দিয়ে মানুষকে নিজের গ্রিপে নিয়ে আসা। একজন সিঙ্গারের জন্য এটা সবচেয়ে বড় গুণ। ও খুব তাড়াতাড়ি শ্রোতাদের আত্মীয় বানিয়ে ফেলত পারফরম্যান্স দিয়ে। আমরা অনেকে মঞ্চে উঠে বলি না কই হাততালি দেন। কিন্তু ওর বেলায় হচ্ছে অটোমেটিক। বলতে হতো না। মানুষ হাততালি দিত তার কথায়-গানে-মিউজিকে মুগ্ধ হয়ে। মিউজিক দিয়ে মানুষকে সম্মোহন করার প্রচণ্ড পাওয়ার ছিল। মিউজিকের জন্য তার ডেডিকেশন, পরিশ্রম ও গান শোনা সেটা আর কজন মিউজিশিয়ানের ছিল এবং আছে, আমার সন্দেহ হয়। সে যে পরিমাণ দেশি-বিদেশি গান শুনত সেটা ভাবাই যায় না।

আমরা শুরুর দিকে মূলত ইনস্ট্রুমেন্টাল বাজাতাম। আমি কিবোর্ড, বাচ্চু গিটার। তখন তার হাতটা পিওর ওয়েস্টার্ন শেখে। তার মধ্যে দুটো ভার্সনই ছিল। সে কিন্তু দেশ ও ওয়েস্টার্ন ব্র্যান্ডিংটা করতে পারত। এটার প্রবর্তক বাংলাদেশে কিন্তু সে-ই। আমরা কেউ না।

এই ফিউশনটাকে তখন বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য করা এটি কিন্তু যেনতেন ব্যাপার না। এটা খুবই কষ্টের। আমরা যে ইমোশনের জাতি সেখানে এসব কাজ করা খুবই রিস্কি। সেই রিস্ক সে একাই পার করে দিয়েছে চোখের সামনে। এসব কথা আমাদের সবার জানা দরকার। প্রজন্মকে জানানো দরকার।

একটি টিভি অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ’৭৫ সালের দিকে। একই এলাকায় থাকতাম, জুবলী রোডে। ওর বাসা আমাদের বাসা ওয়াকিং ডিসটেন্স। আমাদের দুই পরিবারের কেউই চাইত না গানবাজনা করি। কারণ কেউ কখনো তার সন্তানকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে চায় না। আমরা দুজনেই বাবা-মায়ের বড় ছেলে। তো কে চাইবে মিউজিক করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঠেলে দিতে তার সন্তানকে? কিন্তু খালাম্মা আবার আমাকে খুব ট্রাস্ট করত।

আমি ওর বাসায় গেলে বলতেন, ঠিক আছে যাও। তুমি আবার ফেরত দিয়ে যাইবা। একইভাবে আমার মাও বাচ্চুকে ছেলের মতোই জানত। সত্যি বলতে দুই পরিবারের দুজন মায়ের মমতার কারণে আমাদের দুজনের আজকের এ অবস্থান।
সেই সময়ে আমরা যখন রাত্রিবেলায় শো করে ফিরতাম, তখন বাসায় ঢোকা ছিল বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। তখন মাগরিবের আগেই ঢোকার নিয়ম অথচ আমরা রাতের ২-৩টার পর ফিরতাম। তখন আমার মা রান্না করে বেড়ে আমাদের খাওয়াতেন। তখন থেকেই আমার মায়ের প্রতি বাচ্চুর আলাদা একটা টান ছিল। আমার মা বলত, আমার দুইটা ছেলে। আর বাচ্চু বলত তার দুইটা মা। কয়েকদিন আগেও মা আমাকে বলেছেন, বাচ্চুকে একটু আসতে বলিস।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে টেলিভিশনের স্ক্রল দেখে আমি প্রথমে ভাবলাম এটা অন্য কোনো আইয়ুব বাচ্চু। পরে যখন খেয়াল করে পড়লাম সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু, তখন চিৎকার করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলাম। আমার স্ত্রী দৌড়ে এসে বললেন, কী হয়েছে কী হয়েছে...।

যাই হোক এভাবে তার মৃত্যুর খবর ঘুম ভেঙে শুনব এত তাড়াতাড়ি সেটা কল্পনাও করিনি। তার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও শান্তি কামনা করি। পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা। সারাজীবন এত মানুষকে আনন্দ দিয়েছে, নিশ্চয়ই পরজনমে ও আনন্দেই থাকবে। বারবার আমার আজ এ কথাটাই মনে হচ্ছে।

সুখ এটুকুই, একটা সাকসেসফুল মিউজিক্যাল লাইফ পার করে গেছে আমার বন্ধু। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আইয়ুব বাচ্চু।
ভেবে দেখলাম, আমার চেয়ে ওর আপন শুরু থেকে এ পর্যন্ত আর একজনও নেই। আমরা পারলে এক বালিশে ঘুমিয়েছি। এক থালাতে খেয়েছি।

খুব মনে পড়ে। আমরা দুজন প্রথম ঢাকায় এলাম ’৭৮-৭৯ সালের দিকে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল (সাবেক শেরাটন) হোটেলের পাশে সাকুরা বারে আমরা অডিশন দিতে এলাম। মানে পরীক্ষায় পাস করলে এই বারে নিয়মিত বাজানোর সুযোগ হবে। ঢাকায় এসে উঠলাম বাসাবোর একটা হোটেলে। দুই দিন গেল, তার পরও অডিশনে ডাকে না। দুজনের পকেট ফাঁকা। পরিবার থেকে তো ‘না’ বলে আসছি। এর পর এক রাতে হোটেলে বসে বাচ্চুকে বললাম, তোর পকেটে কত আছে? বলল ৫ টাকা। আমার পকেটে হাত দিয়ে পেলাম ১০ টাকা। বললাম, তা হলে আমরা চট্টগ্রাম ফিরে যাব ক্যামনে? বাচ্চু তো আবার বেশ মজার লোক। সে আমার এ টেনশনের কোনো পাত্তাই দিল না। সে আবার বেশ ভোজনরসিক ছিল। বলে, ‘আগে খাইয়া নিই বেটা। পরে অন্য হিসাব।’

আমি পরে ডাক দিলাম বেয়ারাকে। বললাম, আচ্ছা কমের মধ্যে কী আছে নাস্তা (ডিনার)। বলল, পরটা আর ভাজি আছে। বললাম, দুইটা পরোটা আর একটা ভাজি নিয়ে আসো। বেয়ারা আনল। তখন আবার এগুলা খবরের কাগজে মোড়ায়ে দিতো। দুই পরটা একটা পেপারে। আরেকটা পেপারের টুকরায় ভাজি। বেয়ারা আমাদের রুমে আনার সঙ্গে সঙ্গে ভাজির পেপার ভিজে ধপাস করে হোটেল রুমের ফ্লোরে পড়ে গেল! আমি তখন বললাম, বাচ্চু রুটি-ভাজিও তোর কপালে নেই। কী আর করা। পানি খেয়ে শুয়ে পড়।

বাচ্চু বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে বলল, আরে রাখ তোর কপাল। এই বলে সে ফ্লোর থেকে ভাজিটা তুলে নিল আরেকটা কাগজে। এর পর দুজনে সেটা তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। আহারে বাচ্চু... তোর এসব স্মৃতির ভার আমি আর বইতে পারছি না।
বাচ্চুর নিথর দেহ হাসপাতালে ফেলে বাসায় ফিরে এসব ভাবি আর মনে হয়, আজকের ছেলেরা যে মসৃণ একটা পথ পেয়েছে সেটা এই বাচ্চুদের ঘামের বিনিময়ে তৈরি হয়েছে।

এ কথাটা আমরা যেন ভুলে না যাই। এমন হাজার হাজার কষ্টের ঘটনা আছে আমার আর বাচ্চুর। যা বলে শেষ করা যাবে না।

সংগীতের জন্য আমাদের দুই বন্ধুর দু’একটা কষ্টের ঘটনা না বলেও পারছি না। এসব বলতে চাইনি কখনো। না ও, না আমি। তবে এখন বোধহয় বলার সময় এসেছে। কারণ, আমি এসব বলে হালকা হতে চাই। এত এত স্মৃতির ভার আমি একা একা আর বইতে পারছি না।

টিভি অনুষ্ঠানে অতিথি হলেন দুই বন্ধু, মনে পড়ে। তখন আমাদের একমাত্র মিউজিক করার ক্ষেত্র ছিল বিয়ে বাড়ি। ২০-৩০টি বাস ভরে মেহমান আসত বিয়ে বাড়িতে। তাদের তো ঘুমানোর জায়গা দিতে পারত না। তাই আমাদের গান দিয়ে অতিথিদের জাগিয়ে রাখতে হতো। আমরা টানা গাইতাম আগের দিন সন্ধ্যা ৮টা থেকে পরের দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত!

এর মধ্যে হয়তো যার বিয়ে তার শ্বশুর বলেছে মোহাম্মদ রফির গান করার জন্য। আবার কেউ হয়তো আবদার করল ‘মান্না দে’ গাইবার জন্য। যা বলছে যেমনে বলছে তাই আমাদের গাইতে হতো। একবার এমন একটা অনুরোধ রাখিনি আমরা। ভুলে গিয়েছি হয়তো। সকালে আমাদের ইনস্ট্রুমেন্টস গোছাতে গোছাতে বললাম, ভাই আমাদের পারিশ্রমিক? জামাই বলল, আপনারা তো আমার আব্বার অনুরোধের গানটা পরিবেশন করেননিই। সরি ভাই, আপনাদের জিনিসপত্র (গিটার-কিবোর্ড-ড্রামস) দিতে পারব না। আপনারা চলে যান।

পরে ওসব ফেলে রিকশা ভাড়া করে গ্রাম থেকে শহরে ফিরে আসি খালি হাতে। এই যে কষ্টগুলো। এই করুণ কাহিনি আমাদের জীবনে এসেছে।

আরেকটা বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা বলে শেষ করি। দুই বন্ধু মঞ্চে উঠে অনুষ্ঠান শুরু করে দিলাম। বেশ ফুরফুরে মেজাজ আমাদের। হঠাৎ দেখলাম একজন দা হাতে নিয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসছে! আমরা সব ফেলে দৌড় দিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে তাকেই বললাম, ভাই কী হয়েছে? পেছন থেকে ওই লোক বলল, আব্বা নামাজি মানুষ। উনি বলছে গানবাজনা হারাম। তোদের আনছে কে। আজকে তোদের জবাই করে ফেলব, ইত্যাদি। সঙ্গে গালাগালি তো আছেই।

এ কথা শুনে বাচ্চু একদিকে দৌড়াচ্ছে, আমি আরেক দিকে। পায়ে একজনেরও স্যান্ডেল নেই। এর মধ্যে এ দৌড়ের সঙ্গে পেছনে যুক্ত হয়েছে বাড়ির দুই-তিনটা কুকুরও। শেষ সম্বল ইনস্ট্রুমেন্টসও ফেলে এসেছি।

মিউজিকের জন্য এই যে কষ্ট, এই যে বাঁচার দৌড়, সেই দৌড় প্রতিযোগিতায় আমার বন্ধুটি ফার্স্ট হয়ে গেল আজ। বাচ্চু ছাড়া আমি একা, বন্ধুহীন, পরাজিত একজন। থেমে গেল আমাদের দৌড় প্রতিযোগিতা।

আইএমটি